মব সন্ত্রাস সভ্য সমাজে কাম্য নয়

التعليقات · 207 الآراء

এই সময়ে দাঁড়িয়ে যখন আমরা সভ্যতা, মানবিকতা ও অগ্রগতির কথা বলি, তখন সমাজের এক অন্ধকার, আদিম এবং পাশবিক রূপ বারবার

এই সময়ে দাঁড়িয়ে যখন আমরা সভ্যতা, মানবিকতা ও অগ্রগতির কথা বলি, তখন সমাজের এক অন্ধকার, আদিম এবং পাশবিক রূপ বারবার আত্মপ্রকাশ করে। সেই রূপের নাম ‘মব সন্ত্রাস’ বা গণপিটুনি। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া একের পর এক গণপিটুনির ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে আইনের শাসন এবং মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তি কতটা ঠুনকো হয়ে পড়েছে। গুজবের ওপর ভিত্তি করে, নিছক সন্দেহের বশে কিংবা আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার উল্লাসে একদল উন্মত্ত মানুষ যখন একজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে, তখন প্রশ্ন জাগে—আমরা কি সত্যি সভ্য?

‘মব’ বা উন্মত্ত জনতা কোনো একক ব্যক্তি নয়। একজন ব্যক্তি একা যা করতে সাহস পায় না, জনতার অংশ হয়ে সে তা অবলীলায় করে ফেলে। এই মনস্তত্ত্বই মব সন্ত্রাসের মূল চালিকাশক্তি। সামপ্রতিক ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গুজবই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গণপিটুনির জন্ম দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লাগামহীন বিস্তারের ফলে একটি ছোট গুজব বা অসত্য তথ্য দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এবং মুহূর্তের মধ্যে একদল মানুষকে হিংস্র পশুতে পরিণত করে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যের বরাতে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত জুন পর্যন্ত ১০ মাসে ২৫৩টি মব বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। এতে ১৬৩ জন নিহত এবং ৩১২ জন আহত হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) পরিসংখ্যানের বরাতে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত জুনে দেশে অন্তত ৪১টি গণপিটুনির ঘটনায় ১০ জন নিহত হয়। গুরুতর আহত হয় ৪৭ জন।

গণপিটুনির শিকার ৩০ জনকে আহত অবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়। ডাকাতি, চুরি, খুন, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, কটূক্তি, ধর্ম অবমাননা, প্রতারণা ও অপহরণের অভিযোগ এনে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে তাদের।

মব সন্ত্রাসের উত্থানের পেছনে একাধিক গভীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ বিদ্যমান। এর মধ্যে প্রধানতম হলো বিচারব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের তীব্র অনাস্থা। বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি এবং অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীর পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি সাধারণ মানুষের মনে এই বিশ্বাস জন্ম দিয়েছে যে প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থা তাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ।

এই হতাশা এবং ক্ষোভ থেকেই জন্ম নেয় আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা। তারা মনে করে, তাত্ক্ষণিক বিচার প্রতিষ্ঠা করাই একমাত্র পথ। এই ‘তাত্ক্ষণিক বিচার’ আসলে বর্বরতা ছাড়া আর কিছুই নয়, যেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ থাকে না, থাকে শুধু সম্মিলিত জিঘাংসা।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামাজিক অসহিষ্ণুতা এবং নৈতিক অবক্ষয়। ভিন্নমত, ভিন্ন বিশ্বাস বা সামান্য সন্দেহের প্রতিও আমাদের সমাজ দিন দিন অসহনশীল হয়ে উঠছে। অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা এবং মানবিকতার মতো গুণাবলি যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। গণপিটুনির সময় উপস্থিত জনতার উল্লাস, মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ এবং সামাজিক মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা প্রমাণ করে যে আমরা মৃত্যুকেও এক ধরনের বিনোদন হিসেবে দেখতে শুরু করেছি।

রাজনৈতিক মদদপুষ্ট দুর্বৃত্তায়নও মব সন্ত্রাসের অন্যতম কারণ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালী বা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকা গোষ্ঠীগুলো নিজেদের স্বার্থে এই ধরনের ঘটনাকে উসকে দেয় বা অপরাধীদের সুরক্ষা প্রদান করে। যখন রাষ্ট্রযন্ত্র এই উন্মত্ত জনতাকে থামাতে ব্যর্থ হয় বা অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারে না, তখন এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা বা সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতাও মবকে আরো বেপরোয়া করে তোলে। ফলে রাষ্ট্র ও আইনের প্রতি মানুষের শেষ ভরসাটুকুও নষ্ট হয়ে যায়।

মব সন্ত্রাসের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ এবং সুদূপ্রসারী। এ ধরনের ঘটনা সমাজে এক গভীর ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দেয়। মানুষ একে অপরকে সন্দেহ করতে শুরু করে। সামাজিক সম্প্রীতি ও বিশ্বাস নষ্ট হয়, যা একটি সুস্থ সমাজের জন্য অপরিহার্য। মব সন্ত্রাস একটি দেশের আইনের শাসনের ধারণাকেই ধ্বংস করে দেয়। যখন জনতাই বিচারক এবং শাস্তিদাতার ভূমিকা পালন করে, তখন সংবিধান, বিচার বিভাগ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অস্তিত্ব অর্থহীন হয়ে পড়ে।

এই অন্ধকার পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য এখনই সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য প্রথমে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মবের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিচয় যেন তাদের রক্ষা করতে না পারে, রাষ্ট্রকে তা নিশ্চিত করতে হবে।‌ রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে হবে। অপরাধী যেই হোক না কেন, তার শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের হারানো বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।

সেই সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। ডিজিটাল লিটারেসি বা প্রযুক্তিগত সাক্ষরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষকে শেখাতে হবে কিভাবে ভুয়া খবর শনাক্ত করতে হয় এবং তার প্রচার থেকে বিরত থাকতে হয়। মানবিকতা, সহনশীলতা ও পরমতসহিষ্ণুতার শিক্ষা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অংশ করে তুলতে হবে।

التعليقات