খামেনির ভারত যোগ: ভারতীয়দের ইসরায়েল প্রীতি

Yorumlar · 36 Görüntüler

গড়পড়তা ভারতীয়রা ইসরায়েলের সমর্থক বলে একটা প্রচলিত ধারণা আছে, হয়তো সেটা খুব একটা ভুলও নয়।  তবে এই ভারতবর্ষেই

ইউনুস রাজু

গড়পড়তা ভারতীয়রা ইসরায়েলের সমর্থক বলে একটা প্রচলিত ধারণা আছে, হয়তো সেটা খুব একটা ভুলও নয়।  তবে এই ভারতবর্ষেই এমন এক প্রান্ত আছে, যেখানকার মানুষজন ইরানের সঙ্গে আত্মার আত্মীয়তা অনুভব করেন ... ইরানের জন্য তারা রাস্তাতেও নামেন, এমন কী ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলে সেখানেও প্রার্থীদের ছবি দিয়ে পোস্টার পর্যন্ত পড়া। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পূর্ব পুরুষের একসময় বসতি ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশে। 

ভারতের কিন্তুর থেকে ইরানের খোমেইন:

‘খোমেনি: লাইফ অব আয়াতুল্লাহ’ শীর্ষক জীবনীর শুরুতেই আছে খোমেনির দাদার কথা; যার নাম ছিল সৈয়দ আহমেদ মুসাভি হিন্দি। ১৮০০ সালে তার জন্ম হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের বারাবাঁকির কাছের কিন্তুর গ্রামে। তিনি ছিলেন একজন শিয়া ধর্মগুরু ও পন্ডিত।
আহমেদ মুসাভি হিন্দির বাবা দিন আলি শাহ আগে ইরানের কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে ভারতে গিয়েছিলেন ১৭০০ সালের দিকে। মুঘল সাম্রাজ্য পতনের পর ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব বাড়ার সময় পরিবারটি বারাবাঁকিতে বসতি গড়ে তোলে।
১৮০০ সালের দিকে ভারতে ইসলামের পুনর্জাগরণ ও মুসলিমদের অধিকার আদায়ের নতুন ধারা দেখা দিয়েছিল। সৈয়দ আহমেদ মুসাভি হিন্দিও সেই ধারার অনুসারী ছিলেন। ইসলামকে আরও গভীরভাবে জানা ও ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে তিনি ১৮৩০ সালে ভারত ছেড়ে ইরাকের নাজাফে ইমাম আলি-র সমাধি দর্শনে যান।

কিন্তু কিছুদিন সেখানে থাকার পর তিনি ইরানের খোমেইন শহরে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন। সেখানেই তিনি পরিবার গড়েন। তার সন্তান মোস্তফা, এবং মোস্তফার সন্তান হলেন রুহুল্লাহ খোমেনি। তার মানে, ভারতের মাটি থেকে যাত্রা শুরু করা সৈয়দ আহমেদ মুসাভি হিন্দির উত্তরসূরি হয়ে ইরানের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করেছিলেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি।
ইরানের ঐতিহাসিক রেকর্ড থেকে দেখা যায়,আহমেদ মুসাভি হিন্দি তার নামের 'হিন্দি' উপাধিটি রেখে দিয়েছিলেন। এটিই তার ভারতীয় শেকড়ের স্মারক হয়ে আছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিজেকে 'আহমেদ হিন্দি' বলেই পরিচয় দিতেন।
তার সমাধি রয়েছে কারবালায়। রুহুল্লাহ খোমেনি তার দাদাকে কখনও দেখেননি। তবে তিনি তার দাদার বিশ্বাস, ধর্মীয় অনুশাসন ও আদর্শই ধারণ করেছিলেন। খোমেনি নিজেও আজীবন শিয়া মতবাদের ধারক ও বাহক ছিলেন।

ইরানের প্রথম সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খোমেনির জন্ম:

সৈয়দ আহমেদ মুসাভি হিন্দি মারা গিয়েছিলেন ১৮৬৯ সালে। তারও অনেক বছর পর ১৯০২ সালে জন্ম হয় তার নাতি রুহুল্লাহ খোমেনির। তিনি ইরানের রাজনীতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন।
তার নেতৃত্বেই ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব ঘটে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির পশ্চিমা-সমর্থিত রাজতন্ত্রের পতন হয়। ইরান হয়ে ওঠে একটি শিয়া নেতৃত্বাধীন ধর্মতান্ত্রিক দেশ।
তার এই বিপ্লব কেবল ইরানের ভেতরেই নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ভারসাম্য পাল্টে দেয়। খোমেনি ইরানের প্রথম সর্বোচ্চ নেতা হন। তার নেতৃত্বে ইরানে পশ্চিমা-বিরোধী শাসনের ধারা গড়ে ওঠে এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী বিকল্প ধারার অক্ষের গোড়াপত্তন হয়।
১৯৮৯ সালে মারা যান আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। তার মৃত্যুর পর, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার পদে বসেন তারই ঘনিষ্ঠজন ও অনুসারী আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। এখনও তিনি সে পদেই আছেন।

ভারত-ইরান নিঃশব্দ যোগসূত্রের অদৃশ্য সেতুবন্ধন:

ভারতের সেই কিন্তুর গ্রামের জন্য ইরানে আজকের যুদ্ধ-সংঘাতের ঘটনা কেবল দূরের দেশ থেকে আসা কোনও খবর নয়। বরং এই সংঘাত তাদের জন্য ইরানের সঙ্গে সেই ঐতিহাসিক এবং আধ্যাত্মিক যোগসূত্রকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
কিন্তুরের এক বাসিন্দা বলেন, “আজ শান্তির জন্য এই গ্রামের মাটি থেকে প্রার্থনায় আমরা হাত উঠিয়েছি।” কিন্তুরের কাছেরই আরেকটি গ্রাম মহল মোহল্লায় আজও রয়ে গেছে সেই খোমেনিরই বংশোদ্ভুতদের কেউ কেউ।
তারা আজও আধুনিক ইরানের রূপকার হিসাবে তাদের পূর্বপুরুষদের অবদান নিয়ে গর্ব করে। তাদের বাড়ির দেয়ালে আজও দেখা যায় খোমেনির ছবি। খোমেনি যে মূল্যবোধ নিয়ে জীবনযাপন করেছিলেন তা আজও স্মরণ করেন বলে জানিয়েছেন তাদেরই একজন।
কিন্তুর গ্রামটি হয়ত বিশ্ব মানচিত্রে নজরে নেই। কিন্তু ভারতের উত্তর প্রদেশে এই গ্রামটি কেবল একটি ভৌগলিক অবস্থানের চেয়েও বেশি গুরুত্ববাহী। কারণ, এই গ্রাম থেকেই পরিবারের শিকড় বিস্তার হয়ে ইরানের সর্বোচ্চ ক্ষমতা পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা হয়ত অনেকেরই কল্পনার বাইরে।

আর সে কারণেই এই গ্রাম ইরান ও ভারতের মাঝে সংস্কৃতি এবং আবেগের বন্ধন হয়ে আছে। ইতিহাসের এই নিঃশব্দ যোগসূত্র দুই দেশের সম্পর্কের অতীত ও বর্তমানের মাঝে তৈরি করেছে অদৃশ্য এক সেতুবন্ধন। আজ ইরানে যুদ্ধের ডামাডোলে এই কিন্তুর গ্রামের বার্তা একটাই- “আর যুদ্ধ নয়, শান্তির আওয়াজ উঠুক।”

লেখক: ইউনুস রাজু
(ডেপুটি সিএনই, নিউজ টোয়েন্টিফোরটিভি)

বানানরীতি লেখকের নিজস্ব। 

Yorumlar