মুরশিদুজ্জামান হিমু ⚫
যমুনা, এক বহমান নদীর নাম। আমাদের নামও ‘যমুনা’। আমাদেরও চরিত্র সেই বহতা নদীর মতোই। কূল কূল করে বয়ে চলেছি সামনে। কত কে যে ভেসে চলছে আমাদের সঙ্গে এ যাত্রায়। আবার কত কে যমুনার তোড়ে ভেসে চলে গেলো, কে জানে সেই হিসেব। সব পাতা ঝরার শব্দ বৃক্ষ কি শুনতে পায়?
আজ লিখতে বসার কারণ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রচার নয়। নিতান্তই আত্মোপলব্ধি থেকে। কিছুটা স্মৃতিচারণ তো বটেই।
যমুনা মূলত একটি সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন। সংবাদ প্রচার করাই যার মূল ব্রত। এর মাঝে আসে কত লু হাওয়ার আভাস। আসে কত কিছু চেপে যাওয়ার অনুরোধ। দূরালাপনের মিষ্টি কবিতার বদলে কখনও শোনা যায়– ‘দেখে নেবো’, ‘এমন করলে টিকতে পারবেন না’ বা ‘যদি অফ হয়ে যায়’র মতো অসংখ্য ভয়ভীতি। কিন্তু ভয়কে জয় করাই তো আমাদের কাজ। একটা ফোনকলই যদি হ্যান্ডেল করতে না পারি, তবে সাংবাদিকতা করতে কেন এসেছি— এ কথা তখন বাজতে থাকতে কানে।
এমনই ঘটনা পরম্পরায় এসেছিল জুলাই। সেই চব্বিশের জুলাই। শুরু হয়েছিল কিন্তু মনে হচ্ছিল, শেষ হচ্ছে না। আমাদের জন্য সেটা ছিল বিভীষিকাময় সময়। গুলি চলছে, লাশের হিসেব করছি। কিন্তু কোনো হিসেব মিলছে না।
যমুনা টেলিভিশন শুরু থেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলন কাভার করেছে। যেমনভাবে কাভার করা হয় প্রতিটি ইভেন্টই। আমরা গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। যেমনটা চেষ্টা থাকে অন্য নিউজের ক্ষেত্রেও।
কে কী ভাবে জানি না, একটা কথা না বললেই নয়— সে সময় যদি ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল অথবা অন্য কোনো সংগঠন যৌক্তিক কোনো আন্দোলন করতো, সেটাকেও সমান গুরুত্ব দিতো যমুনা টেলিভিশন। যেমনটা দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজপথযাত্রাকে।
আমরা যেমন সে সময় ছাত্র আন্দোলনের যৌক্তিক দাবিকে স্ক্রিনে তুলে ধরেছি, তেমনি তাদের পথ আটকে আন্দোলন করায় জনভোগান্তিও আমাদের চোখ এড়ায়নি। আমরা আন্দোলনকারীদের ‘দুষ্কৃতিকারী’ হিসেবে পরিচয় করাইনি। আর আন্দোলনের কারণে যাদের হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়েছে, তাদের নিউজের ক্ষেত্রে ‘হাঁটতে হাঁটতে জীবন শেষ’ টাইপ শিরোনামও আমরা দেইনি।
আমরা আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার ছবি দেখাতে ভয় পাইনি। দেখিয়েছি পুলিশের সাঁজোয়া যান (এপিসি) থেকে লাশ ফেলে দেয়ার ছবি। প্রকাশ্যে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ অনেকেই হয়তো চেপে গিয়েছিলেন কিন্তু যমুনা যখন সাংবাদিকতা করতে এসেছে, তখন এমন খবর চাপা থাকে কীভাবে? না, থাকেনি। যমুনাই দেখিয়েছে জাতিকে, পুরো বিশ্বকে।
আজকালকার যুগে তো ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট থেকেই যায়। কারও যদি স্মৃতিশক্তি দুর্বল কিংবা স্মৃতি বিস্মৃত হয়ে যায়, চাইলেই একটু কষ্ট করে সে সময়ের কাভারেজ দেখে নিতে পারেন।
সাংবাদিকতায় বিশেষ কোনো দল বা গোষ্ঠীর প্রতি আলাদা মমতা দেখানোর সুযোগ নেই, কেউ আমাদের বিরাগভাজনও নয়। সেই ‘এথিকস অব জার্নালিজম’ যমুনা সব সময়ই মেনে চলার চেষ্টা করে। খুবই স্পষ্ট করে বলি, কখনোই কোনো দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার পরিকল্পনা আমাদের ছিল না, এখনও নেই। পুরোদস্তুর সংবাদকর্মীরা তা কখনও করতেও পারে না। তার চোখে ‘এ’-ও যা, ‘বি’-ও তা। তাই বলে সত্যকে সত্য বলা বন্ধ করতে চাইনি আমরা। সেই সাহসই সবসময় দেখিয়েছে যমুনা টেলিভিশন। সেই সত্যের পথে এগোতে গিয়ে কারও অপকর্ম যদি প্রকাশ পেয়ে থাকে, দুর্বৃত্তের যদি ক্ষতিসাধন হয়, সংবাদমাধ্যম হিসেবে তখন আমরা কী-ই বা করতে পারি?
উত্তাল সেই দিনগুলোতে যে আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা কেউ করেনি, এমনও নয়। আমাদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে (সিইও) বিশেষ বলয়ে ডেকে নেয়া হয়েছে। ‘ওমুক নিউজ কেন এভাবে দেয়া হলো’, জবাবদিহি করা হয়েছে প্রধান বার্তা সম্পাদককে। বিশেষ দফতর থেকে লিংক পাঠিয়ে নিউজ সোস্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম থেকে সরাতে বাধ্য করা হয়েছে। তখনও আমরা কিন্তু সাংবাদিকতাই করেছি। আমরা জানতাম, এটাই সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ, এটাই ‘বিউটি অব জার্নালিজম’।
তবে একটা জিনিস আমরা বুঝেশুনে করেছি। প্রতিটা পা ফেলেছি সাবধানে, দেখে-শুনে। জানতাম, একটু ভড়কালেই বিপদ। যে বিপদের মাশুল গুনে শেষ করা যাবে না। সংকুচিত পরিসরেও পেশাদারিত্বের মধ্যে থেকেছি। মাঠ এবড়ো-থেবড়ো হলেও আমরা আমাদের স্বাভাবিক খেলা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। ব্যস এতোটুকুই।
পদে পদে বাঁধা যে আবার নতুন করে এগিয়ে চলার প্রেরণা দেয়, চব্বিশের জুলাই তা প্রমাণ করেছে। আমরা নিজেরা তা অনুভবও করি। তাই যখনই বাধা আসে, মনে মনে স্মরণ করি সেই পঙক্তি—
‘কী জানি কী হল আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান…’
ওরে, চারি দিকে মোর
এ কী কারাগার ঘোর –
ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘাত কর্।
ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি,
এসেছে রবির কর।‘
লেখক: সংবাদকর্মী