নাসা কেন চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি বানাতে চায়?
নাসা বহু বছর ধরেই মহাকাশে পারমাণবিক শক্তি নিয়ে কাজ করছে ও তহবিল দিচ্ছে। এবার কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা বা তারিখ ঠিক করে দিয়েছে সংস্থাটি– এটিই নতুন বিষয়।
তিনি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রযুক্তিবিদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং অর্জন করেছেন সংস্থাটির সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘ডিসটিংগুইস্ট সার্ভিস মেডেল’ পেয়েছেন। তার অন্যান্য যোগ্যতার মধ্যে রয়েছে মহাকাশে পারমাণবিক চুল্লির কার্যপদ্ধতি নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে সাক্ষ্য দিয়েছেন, এমনকি তেজস্ক্রিয় পদার্থবাহী রকেট উৎক্ষেপণ সংক্রান্ত নীতিমালাও তিনি নতুন করে তৈরি করতে সহায়তা করেছেন বলে প্রতিবেদনে লিখেছে প্রযুক্তি বিষয়ক সাইট এনগ্যাজেট।
সম্প্রতি ‘ওয়েইং দ্য ফিউচার: স্ট্র্যাটেজিক অপশনস ফর ইউএস স্পেস নিউক্লিয়ার লিডারশিপ’ শিরোনামে এক গবেষণাপত্র লিখেছেন লাল ও তার সহলেখক ড. রজার মায়ার্স। এ গবেষণায় তারা তুলে ধরেছেন, মহাকাশে পারমাণবিক শক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগের বিভিন্ন নীতি কীভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং তারা যুক্তি দিয়েছেন যে, ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে ছোট আকারের এক পারমাণবিক সিস্টেম পরীক্ষা করা উচিত।
তাদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রকে মহাকাশে পারমাণবিক নেতৃত্ব নিতে হলে বাস্তব পরীক্ষা চালানো জরুরি, আর চাঁদ হচ্ছে তার জন্য আদর্শ স্থান। এ গবেষণাপত্রে ভবিষ্যতের জন্য কৌশলগত দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন তারা।
মহাকাশ গবেষণাভিত্তিক অলাভজনক সংগঠক ‘দ্য প্ল্যানেটারি সোসাইটি’র মহাকাশ নীতির প্রধান কেসি ড্রেয়ার বলেছেন, সেক্রেটারি ডাফির পরিকল্পনার অনেক অংশই এই গবেষণা থেকে ‘সরাসরি নেওয়া হয়েছে’ বলে মনে হচ্ছে।
লাল নিজের অবদান বা গবেষণার বিষয়ে বিনয়ী স্বরে বললেন, ডাফি যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেটা আসলে নাসার আগের কাজকেই কেবল ‘আরও দ্রুত এগিয়ে নেওয়া’।
তিনি বলেছেন, নাসা বহু বছর ধরেই মহাকাশে পারমাণবিক শক্তি নিয়ে কাজ করছে ও তহবিল দিচ্ছে। এবার কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা বা তারিখ ঠিক করে দিয়েছে সংস্থাটি– এটিই নতুন বিষয়।
“আমরা ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজটি করছি।”
এ ছাড়াও, লাল মনে করিয়ে দিয়েছেন, নাসা যদি সত্যিই ডাফির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে তবে সেটিও মহাকাশে পাঠানো যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পারমাণবিক চুল্লি হবে না। কারণ, ১৯৬৫ সালে ‘এসএনএপি-১০এ’ নামের এক পারমাণবিক চুল্লি প্রথমবারের মতো মহাকাশে পাঠিয়েছিল সংস্থাটি।
যুগের পর যুগ ধরে মহাকাশে ব্যবহারের উপযোগী পারমাণবিক চুল্লি নিয়ে গবেষণা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র, যার পেছনের কারণ বোঝা আসলে বেশ সহজ। চুল্লি পদার্থবিদ ও ‘হোয়াট ইজ নিউক্লিয়ার’ নামের প্ল্যাটফর্মের প্রতিষ্ঠাতা নিক টুরান বলেছেন, “আপনি খুব অল্প ভর থেকে বিপুল পরিমাণ শক্তি পেতে পারেন। আর মহাকাশযানে ওজন যত কম হবে উৎক্ষেপণ তত সহজ ও কম খরচে সম্ভব হবে।
ফলে এমন কোনো শক্তির উৎস দরকার যেটা হালকা তবে বেশি শক্তি উৎপাদন করতে পারে এবং পারমাণবিক শক্তি হচ্ছে সেই সমাধান।
ড. লাল বলেছেন, “আমরা ঠিক কতটা শক্তির কথা বলছি? একটি টেনিস বল আকৃতির ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর যদি সম্পূর্ণভাবে ফিশন করা যায় তবে তা এক মালবাহী ট্রেনভর্তি কয়লার সমান শক্তি দিতে পারে।”
সৌরশক্তি মহাকাশযানে ব্যবহৃত হলেও সূর্য থেকে দূরে গেলে তা দুর্বল হয়ে যায়।
যেমন– চাঁদের অন্ধকার পাশ বা মঙ্গল গ্রহ ও অন্যান্য মিশনে সৌরশক্তি অনেক সীমিত থাকে। তবে পারমাণবিক শক্তি সূর্যনির্ভর নয়, বরং দিনরাত, কাছের বা দূরের যাত্রা, সব ক্ষেত্রেই গেইম চেঞ্জার হিসেবে কাজ করতে পারে এটি।
উদাহরণ হিসেবে ‘নিউ হরাইজনস’ মহাকাশযানের দিকে ইঙ্গিত করেছেন ড. লাল। ২০১৫ সালে ‘নিউ হরাইজনস’ প্লুটোর পাশ দিয়ে উড়ে গিয়েছিল এবং বামন গ্রহটির অসাধারণ কিছু ছবিও তুলেছিল মহাকাশযানটি। তবে পর্যাপ্ত শক্তি না থাকায় প্লুটোর কক্ষপথে প্রবেশ করতে পারেনি এটি।
ড. লাল বলেছেন, “নিউ হরাইজনস-এ কেবল দুইশো ওয়াট বিদ্যুৎ ছিল, যা প্রায় দুটি সাধারণ লাইট বাল্বের সমান।”
ফলে ৫০ গিগাবাইটেরও বেশি তথ্য পৃথিবীতে পাঠাতে ১৬ মাস লেগে যায় মহাকাশযানটির। এত কম শক্তিতে সব ডেটা পাঠানো ধীর ও সীমিত ছিল।
ড. লাল বলেছেন, মহাকাশযানটির সঙ্গে যদি ২০ কিলোওয়াটের ছোট এক পারমাণবিক চুল্লি থাকত তবে এটি প্লুটোর কক্ষপথে যেতে, এর সব যন্ত্র একসঙ্গে চালু রাখতে ও এসব তথ্য রিয়াল টাইমে পৃথিবীতে পাঠানো সম্ভব হত।
চাঁদের ক্ষেত্রে পারমাণবিক শক্তি হতে পারে একেবারে গেইম চেঞ্জার প্রযুক্তি। চাঁদের এক রাতের দৈর্ঘ্য পৃথিবীর হিসেবে প্রায় ১৪ দিনের সমান। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহটিতে এমন কিছু ক্রেটার বা গর্ত রয়েছে, যেখানে কখনও সূর্যের আলো পড়ে না। এ অবস্থায় সৌরশক্তি দিয়ে নাসা যদি স্থায়ী কোনও ঘাঁটি বানাতে চায় তবে দুসপ্তাহ ধরে বিদ্যুৎ না থাকার ঝুঁকি পার করতে হলে প্রয়োজন অনেক ‘বিশাল সংখ্যাক’ ব্যাটারি। আর এসব ব্যাটারি চাঁদে পাঠাতে হবে পৃথিবী থেকে, যা ব্যয়বহুল ও কঠিন কাজ।
ড. লাল বলেছেন, “এক সময় চাঁদে আমরা শিল্প মানের কাজ করতে চাইব। এমনকি সেখানে থ্রিডি প্রিন্টার ব্যবহার করতে হলেও শত শত কিলোওয়াট বিদ্যুৎ তো লাগবেই, এমনকি এর বেশিও লাগতে পারে। ফলে চাঁদে যদি কোনো ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম করতে চাই তবে কেবল সৌরশক্তিই যথেষ্ট হবে না।”
এদিকে, মঙ্গল গ্রহের ক্ষেত্রে পারমাণবিক শক্তি একেবারেই অপরিহার্য। কারণ লাল গ্রহটিতে ধুলার ঝড় হয়, যা সপ্তাহ বা মাস ধরে চলতে পারে। ফলে তা কখনও কখনও পুরো গ্রহকেও ঢেকে ফেলতে পারে। এ ধুলার ঝড়ে সূর্যের আলো গ্রহের পৃষ্ঠে পৌঁছাতে পারে না। এ পরিস্থিতিতে সৌরশক্তি অচল হয়ে যায়।
নাসার ‘অপর্চুনিটি’ রোভার প্রায় ১৫ বছর ধরে মঙ্গলে কাজ করেছে এবং শেষ পর্যন্ত বড় পরিসরের এক ধুলার ঝড়ের কবলে পড়ে তা বন্ধ হয়ে যায়। সেই ঝড়ে রোভার সূর্যের পর্যাপ্ত আলো পায়নি। ফলে এর সোলার প্যানেল বিদ্যুৎ তৈরি করতে না পারায় শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়।
এ কারণে যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই মঙ্গলে স্থায়ী কোনো উপস্থিতি বা ঘাঁটি গড়ে তুলতে চায় তবে চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি প্রযুক্তি আগে পরীক্ষা করা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে করেন ড. লাল।
তিনি বলেছেন, “আমরা চাই না আমাদের প্রথম পারমাণবিক চুল্লি প্রথমবারের মতো মঙ্গলেই চালু হোক। আমরা আগে যেটি চাঁদে পরীক্ষা করতে চাই। আমার ধারণা নাসাও সেটিই করার চেষ্টা করছে।”
এ পুরো পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে গেলে নাসাকে অনেক প্রযুক্তিগত বাধা পার করতে হবে, যেখানে সবচেয়ে সহজ সমস্যা হতে পারে একশ কিলোওয়াট মাইক্রোরিঅ্যাক্টর খুঁজে বের করা। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কোনও কোম্পানি মাইক্রোরিঅ্যাক্টর তৈরি করছে না।
‘অ্যাটমিক্স ইন্টারন্যাশনাল’ ও ‘নর্থ আমেরিকান এভিয়েশন’ এক সময় এসব প্রযুক্তি তৈরি করলেও দশক আগেই তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এ দুটি কোম্পানিই ১৯৬৫ সালে মহাকাশে পাঠানোর জন্য ‘এসএনএপি-১০এ’ পারমাণবিক চুল্লি তৈরি করেছিল।
নিউক্লিয়ার বিশেষজ্ঞ নিক টুরান মনে করেন, ভালো খবর হচ্ছে এ প্রকল্পের জন্য এক কার্যকর চুল্লি তৈরিতে নাসা বা কোনও কোম্পানির হাতে এখনও যথেষ্ট সময় আছে।
তিনি বলেছেন, “আমার মনে হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি বসানোর জন্য দারুণ অবস্থানে রয়েছি আমরা।”
২০১৮ সালে নাসা ও যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি মন্ত্রণালয় মিলে পরীক্ষামূলকভাবে হালকা ও ১০ কিলোওয়াট সক্ষমতার ফিশন সিস্টেম তৈরি করেছিল, যার নাম ছিল ‘ক্রার্স্টি’।
টুরান বলেছেন, “এটি ছিল কয়েক দশকের মধ্যে চালু হওয়া অন্যতম নতুন চুল্লি এবং খুব সীমিত বাজেটেই তৈরি হয়েছিল এটি।”
শেষ পর্যন্ত চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি পাঠানো সম্ভবত সেটি বানানোর চেয়েও কঠিন হতে পারে। ড. রজার মায়ার্সের কিছু প্রাথমিক হিসাব অনুসারে, একটি একশ কিলোওয়াট চুল্লির ওজন হতে পারে ১০ থেকে ১৫ টন। অথচ বর্তমানে কোনো বাণিজ্যিক রকেট এত ভারী বস্তু মহাকাশে বহন করতে পারে না, বিশেষ করে চাঁদ পর্যন্ত তো নয়ই।
আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে চুল্লির রেডিয়েটর বা তাপ ছাড়ার যন্ত্রাংশ খুব বড় হবে, এমনকি সম্পূর্ণ খোলা অবস্থায় এটি এক বাস্কেটবল কোর্টের সমান বড় হতে পারে। ফলে নাসাকে এমন এক পদ্ধতি বের করতে হবে, যাতে রকেটের মধ্যে এটিকে ভাঁজ করে রাখা যায় এবং পরে চাঁদে গিয়ে সঠিকভাবে খুলে ব্যবহার করা যায়।
ড. লাল ও রজার মায়ার্স তাদের গবেষণায় অনুমান করেছেন, চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি তৈরি ও বসাতে পাঁচ বছর ধরে বার্ষিক প্রায় ৮০ কোটি ডলার খরচ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি বিভাগ সহায়তা দিলে নাসা কিছুটা সাহায্য পেতে পারে, যেমন, কর্মী ছাঁটাই বা বাজেট সংকট সামলাতে পারার মতো বিষয়।
তবে প্রকল্পটি সফল হবে কি না তা অনেকটাই নির্ভর করবে ট্রাম্প প্রশাসন নিজের ঘোষণা অনুসারে আসলেই এতে অর্থায়ন করে কি না তার ওপর।
গত সপ্তাহে চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি বানানোর ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন মন্ত্রী সিন ডাফি। সাই-ফাই প্রেমী হিসেবে ভবিষ্যতে চাঁদে স্থায়ী বসতির জন্য পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার কল্পনা করা গেলেও আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে চাঁদে একশ কিলোওয়াটের পারমাণবিক চুল্লি বাসাবে নাসা– এ ধারণা এক সময় আসলেই হাস্যকর মনে হত।
তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধারণা মোটেও অবাস্তব নয়।
“বিষয়টি নিয়ে এত হইচই হচ্ছে কেন, আমি বুঝতেই পারছি না,” ফোনে খানিকটা বিরক্তির আভাস দিয়ে বললেন অধ্যাপক ভব্য লাল। তার ক্যারিয়ারের গতিপথ বুঝতে পারলে লালের বিরক্তির কারণ খানিকটা বোঝা যায়। লাল নিজের পেশাগত জীবনের বড় একটা অংশই ব্যয় করেছেন মহাকাশে