চাঁদাবাজি-মাদক দমনে এখনই সুবর্ণ সুযোগ

Comments · 22 Views

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলের পর চাঁদাবাজও বদল হয়েছে। তবে চাঁদাবাজি বদলায়নি। নতুন মুখ গজিয়ে পাল্টেছে ধরন। মাদক ?

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলের পর চাঁদাবাজও বদল হয়েছে। তবে চাঁদাবাজি বদলায়নি। নতুন মুখ গজিয়ে পাল্টেছে ধরন। মাদক কারবারেও তাই। গত এক বছরে কোনো মাদক কারবারি এ কারবার ছেড়ে দিয়েছে—এমন তথ্য নেই; বরং এ সেক্টরে পুরনোদের সঙ্গে নতুনদের সম্মিলন ঘটেছে। অথচ জন-আকাঙ্ক্ষা ছিল ক্যান্সারের মতো ভর করা এ দুই আপদ থেকে মুক্তির। সেই লক্ষণও কিছুটা দেখা দিয়েছিল চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সেনাসহ যৌথ বাহিনীর কর্মতৎপরতায়। দীর্ঘদিন ধরে জেঁকে বসা চাঁদাবাজরা হয় গা ঢাকা দিয়েছে, নয়তো এ কাজে দম ধরেছে।
একইভাবে মাদক কারবারিরাও। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে নতুন ছন্দ। চাঁদাবাজির অভিযোগ বাংলাদেশে নতুন নয়। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর অনেকে ভেবেছিলেন, এই চক্রের যবনিকা ঘটবে।

বাস্তবে তা হলো না। চাঁদাবাজির ধরন বলতে চাঁদাবাজির নতুন নতুন পদ্ধতি বা কৌশলগুলোকে বোঝায়, যা অপরাধীরা ব্যবহার করে। আগে যেখানে সরাসরি শারীরিক হুমকি বা ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা হতো, এখন সেখানে অনলাইনে প্রতারণা, সাইবার ক্রাইম বা অন্যান্য সূক্ষ্ম কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। সরকারের চেষ্টা বা আন্তরিকতায় কমতি আছে, তা বলা যাবে না। চেষ্টায় কুলাচ্ছে না।

সংবিধান, প্রশাসন, বিচার, অর্থনীতি প্রভৃতি খাতে সরকার সংস্কার আনার যারপরনাই চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টায় কম-বেশি সাফল্য আসার সম্ভাবনাও রয়েছে। মাদক বা চাঁদাবাজি দমনে কোনো কমিশন বা কমিটি না করেও সরকার কিছু দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে। এত দিন তেমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে এখন নেওয়া যাবে না—বিষয়টি এমন নয়। গত এক বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আইন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিলে কোনো পদক্ষেপ নিলে কোনো দল থেকে আপত্তি আসবে না; বরং তা একটি ইতিহাস গড়বে। সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টারা হবেন জীবন্ত কিংবদন্তি। এ দেশের মানুষ তাঁদের জনমভর উচ্চাসনে সম্মানীয় করে রাখবেন। এমন সোনালি সময় বারবার আসে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, চাঁদাবাজরা রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে নিজেদের রক্ষা করে। প্রশাসনের ভেতর থেকেও তাদের সহযোগিতা পাওয়া যায়। তাই আন্তরিকতার ঘাটতি না থাকলেও রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাবই মূলত সমস্যাকে অমীমাংসিত রাখছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মাদক ও চাঁদাবাজি দমন। রাষ্ট্র যদি আন্তরিকভাবে চায়, তবে এটি সম্ভব। শর্ত হলো—আইনের যথাযথ প্রয়োগ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সমাজভিত্তিক আন্দোলন এবং মানবিক পুনর্বাসন কর্মসূচির সমন্বয়। ইতিহাস গড়ার মতো কাজ এখানেই সম্ভব, যদি নেতৃত্ব দৃঢ় হয় এবং আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা যায়। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে শুধু সরকার পরিবর্তন নয়, দরকার রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। বাস্তবতার নিরিখে রাজনৈতিক দলগুলোকে এ সময়ে সেই সদিচ্ছার বাইরে থাকার সুযোগ নেই। বর্তমানে সেনাবাহিনী ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে মাঠে আছে—এটিও চাঁদাবাজি-মাদক রোখার জন্য একটি আশীর্বাদ। অবশ্য উদ্দেশ্যবাদী মহল বরাবরই ছিল, থাকবেও। তারা জুলাইকে ‘মানি মেকিং মেশিনে’ পরিণত করেছে। আবার অ্যাকশন কড়া হলে হনুমানের লেজে আগুন লাগার মতো দম ধরা বা গাঢাকা দেওয়ার রেকর্ডও আছে।

সেই দৃষ্টে শহর-গ্রামাঞ্চল, সর্বত্রই ক্রাশ প্রোগ্রাম নেওয়া যেতে পারে। শুধু আহবান বা পিঠ বোলানোতে এরা দমবে না, তা পরিষ্কার। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা-মাদকের ভয়াবহতা নতুন উদ্যমে বাড়ছে। হাত বাড়ালেই মাদক মিলছে। চাঁদাও আসছে। ইয়াবা, আইস, গাঁজা, ফেনসিডিল থেকে শুরু করে বিভিন্ন কেমিক্যাল ড্রাগ যুবসমাজকে ক্রমে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। শুধু শহর নয়, গ্রাম পর্যন্ত এই সমস্যার বিস্তার ঘটেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা মাদক সিন্ডিকেট, যা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর জন্যও এক বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে চাঁদাবাজি আজ ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এক অনিবার্য আতঙ্ক। ছোট দোকানদার থেকে শুরু করে বড় শিল্পপতি, সবাই কোনো না কোনোভাবে চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন। এগুলো শুধু অপরাধ নয়, রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সরাসরি হুমকি। আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে এ দুটি সমস্যা এমনভাবে গেঁথে গেছে, এটি একটি সমাজের জন্য নিঃসন্দেহে অশনিসংকেত। এর বিস্তার ঠেকানোর কোনো বিকল্প নেই।

শুধু আইন করলেই হয় না, কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হয়। মাদক মামলায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল কার্যকর করা যেতে পারে। একইভাবে চাঁদাবাজির মামলায় প্রমাণিত অপরাধীদের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে রায় ঘোষণার ব্যবস্থা করা জরুরি। বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন অনেক পুরনো। নতুন যুগের মাদক, যেমন—আইস বা কেমিক্যাল ড্রাগের বিরুদ্ধে আলাদা ধারা যোগ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে ‘অবৈধ অর্থ লেনদেন’ প্রতিরোধে সাইবার নজরদারি বাড়াতে হবে। শুধু পুলিশি অভিযান দিয়ে মাদক দমন সম্ভব নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, সামাজিক সংগঠন, সবাইকে যুক্ত করে এক ধরনের সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

সৌদি আরব, ইরান কিংবা মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোতে মাদক ও দুর্নীতির ক্ষেত্রে কঠোরতম শাস্তি কার্যকর করা হয়েছে। কেউ কেউ মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দিয়ে থাকে। থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোতে মাদকবিরোধী যুদ্ধ কার্যত রাষ্ট্রের নীতি হিসেবে চালানো হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে মানবাধিকারের ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে এখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে, কঠোরতা হোক বা পুনর্বাসন কর্মসূচি, উভয়ই একসঙ্গে চালাতে হবে। একজন আইন ও বিচার মন্ত্রী বা উপদেষ্টা যদি কার্যকরভাবে মাদক ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে পারেন, এতে তিনি ইতিহাসে আলাদা জায়গা করে নেবেন। বাংলাদেশ যদি এখন আন্তরিকভাবে কঠোর পদক্ষেপ নিতে না পারে, তাহলে সামনে সেই সুযোগ আরো আসবে—এমন নিশ্চয়তা নেই।

রদ্রিগো দুতের্তে যখন মাদকবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, তখন দেশজুড়ে হাজার হাজার অভিযানে বহু মানুষ নিহত হয়। এর ফলে আন্তর্জাতিক মহলে মানবাধিকার ইস্যুতে প্রবল সমালোচনা তৈরি হয়। তবে এটাও সত্য যে মাদক সিন্ডিকেটগুলো বড় ধাক্কা খেয়েছিল। এখান থেকে বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা হলো—শক্ত হাতে দমন করতে হবে, তবে মানবাধিকারের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।

২০০০ সালের দিকে থাইল্যান্ডও ইয়াবাসংকটে ডুবে গিয়েছিল। সরকার ব্যাপক অভিযান চালায়, হাজার হাজার লোক গ্রেপ্তার হয়। কিন্তু শুধু পুলিশি অভিযান সমস্যার সমাধান আনতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে তারা পুনর্বাসন কর্মসূচি ও শিক্ষা প্রচারণাকে জোরদার করে। যার ফলে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে। মেক্সিকোর ড্রাগ কার্টেল আজও সরকারের জন্য দুঃস্বপ্ন। কঠোর আইন, সেনা অভিযান, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা—সবই হয়েছে, কিন্তু রাজনীতি ও প্রশাসনের ভেতরে দুর্নীতির কারণে মাদকচক্র অটুট থেকেছে। এ অভিজ্ঞতা বাংলাদেশকে শিখিয়েছে, মাদক দমন শুধু পুলিশের কাজ নয়, এর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা অপরিহার্য।

মুসলিম বিশ্বের কয়েকটি দেশ মাদকের ক্ষেত্রে ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতি নিয়েছে। সৌদি আরবে মাদক পাচার বা ব্যবসায় জড়িত থাকলে সরাসরি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এতে অনেকাংশে ভয় তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে মাদক আজ শুধু আইন-শৃঙ্খলার বিষয় নয়, এটি একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চক্রের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। ইয়াবার চালান সীমান্ত পেরিয়ে আসে, আবার দেশের ভেতরেও নানা স্তরে ‘সুরক্ষা জাল’ তৈরি হয়। চাঁদাবাজির ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। ছোট থেকে বড়, অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পরিচয়কে ঢাল বানিয়ে এই অপরাধীরা কার্যত অপ্রতিরোধ্য। বাংলাদেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনকে যুগোপযোগী করতে হবে। আইস বা নতুন ধরনের সিন্থেটিক ড্রাগের জন্য আলাদা বিধান যোগ করতে হবে। চাঁদাবাজির ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শক্তিশালী করা জরুরি। দ্রুত বিচার আইনের আওতায় মাদক ও চাঁদাবাজির মামলার নিষ্পত্তি করা দরকার। দেরিতে বিচার মানেই অপরাধীদের সাহসী করে তোলা।

Comments