ইলিশের দাম কমে না কেন, জেলে-ব্যবসায়ী-ক্রেতা কার কী মত?

মন্তব্য · 20 ভিউ

বলা হয়ে থাকে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। এই মাছের মধ্যে আবার জাতীয় মাছ ‘ইলিশ’।

বলা হয়ে থাকে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। এই মাছের মধ্যে আবার জাতীয় মাছ ‘ইলিশ’।

কিন্তু ভরা মৌসুমে নিম্নবিত্ত তো বহুদূর, অনেক মধ্যবিত্তের পাতেও ওঠে না ইলিশ। এর মূল কারণ উচ্চমূল্য। ক্রেতাদের অভিযোগ, কোনো উৎপাদন খরচ না থাকলেও এই মাছ নিয়ে বরাবরের মতো এবারও বাজারে এক ধরনের সিন্ডিকেট সক্রিয়। তারা ইলিশ ধরা থেকে বাজারে বিক্রি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যায় এই সুস্বাদু মাছ। মৎস্য অধিদপ্তরের বক্তব্যও প্রায় একই রকম। কিন্তু মাছ ধরা জেলেসহ ব্যবসায়ীদের দাবি, ইলিশ ধরতে খরচ বেশি বলে বাজারে দাম বাড়তি দেখা যায়।

 

ঢাকার বর্তমান বাজারচিত্র অনুসারে, বিগত যেকোনো সময়ের থেকে এবার ইলিশের দাম বেশি। ছোট, বড় ও মাঝারি ইলিশের দাম কেজিতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বর্তমানে বাজারে একটি ইলিশের দাম দিয়ে দুই মাসের গ্যাস বিল ও পোশাক খাতের একজন শ্রমিকের প্রায় ছয় দিনের মজুরির দেওয়া যায়। ঢাকায় এক থেকে সোয়া কেজি ওজনের একটি ইলিশের দাম প্রায় আড়াই হাজার টাকা, মাঝারি আকারের (৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম) এক কেজি ইলিশের দাম ১৮শ’ থেকে দুই হাজার টাকা। আর ছোট আকারের ইলিশ (৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম) এক কেজির দাম দেড় হাজার টাকার ওপরে। অবশ্য সাগরের ইলিশের দাম এর থেকে কিছুটা কম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্যবৃদ্ধি শুধু সাম্প্রতিক প্রবণতা নয়, অনেক দিন ধরেই ইলিশের দাম চড়া। নদী বা সাগর থেকে ইলিশ আহরণের পর ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর আগে কয়েকটি হাত ঘোরে ইলিশ। প্রথমত জেলের কাছ থেকে যায় মহাজনের হাতে। এরপর আড়তদার হয়ে যায় পাইকারদের কাছে। সর্বশেষ যখন খুচরা ব্যবসায়ী কিংবা পাড়া-মহল্লার বাজারে পৌঁছায়, তখন ইলিশের দাম এমন পর্যায়ে ওঠে যে, তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় ১৯ জুন এক কেজি ইলিশের দাম ছিল আকারভেদে এক হাজার থেকে দুই হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত। ২০১৫ সালে দেশে খুচরা পর্যায়ে ইলিশের গড় দাম ছিল ৫৯০ টাকা। একই সময়ে রুই ও তেলাপিয়ার দাম বাড়েনি। কাতলা ও পাঙাশের দামও কমেছে। ফলে বলার সুযোগ নেই যে অন্য মাছের সরবরাহে ঘাটতির কারণে ইলিশের দাম বাড়তি।  

ভোলা-পটুয়াখালী-বরিশাল-চাঁদপুর-ঢাকা: কোথায় কত দাম

গত মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) ভোলার আড়তে জাটকা ইলিশের হালি বিক্রি হচ্ছিল ৬০০-৭০০ টাকা। মাঝারি আকারের প্রতি হালি ইলিশ ১০-১২ হাজার টাকা, আর বড় আকারের হালি বিক্রি হচ্ছিল ১৪-১৫ হাজার টাকায়।

বরিশালের ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) জানান, এদিন বাজারে ৩০০ গ্রামের বেশি ওজনের ইলিশের মণ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ হাজার টাকা (কেজি ১১২৫ টাকা প্রায়)। ৩০০ গ্রামের কম ওজনের গোটলা ইলিশের মণ বিক্রি হচ্ছে ৩২ হাজার টাকা। জাটকা ইলিশের মণ ২৭ হাজার ২৮ হাজার টাকা; ৭৫০ থেকে ৯৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশের মণ ৯০ হাজার টাকা, এক কেজি ওজনের ইলিশের মণ ৯৫ হাজার টাকা, আর এক কে‌জির বেশি ওজনের ইলিশের মণ বিক্রি হচ্ছে এক লাখ দুই হাজার থে‌কে এক লাখ পাঁচ হাজার (কেজি ২৬শ টাকা প্রায়) টাকা পর্যন্ত।

অপরদিকে পটুয়াখালীর আলীপুর-মহিপুর বন্দরে দেখা গেছে, এক কেজি থেকে তার ওপরে প্রতিমণ ইলিশ বিক্রি হয় ৭০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকা দরে। এ হিসেবে প্রতিকেজি বিক্রি হয় ১৭৫০ থেকে ১৮৭৫ টাকা পর্যন্ত। ৬০০ গ্রাম থেকে ৯০০ গ্রাম আকারের ইলিশ বিক্রি হয় ৫৮ হাজার টাকায় (প্রতিকেজি ১৪৫০ টাকা)। এছাড়া ৩০০ গ্রাম থেকে ৬০০ গ্রামের গোটলা ইলিশ বিক্রি হয় ২১ হাজার ৫০০ টাকা মণ দরে (কেজি প্রায় সাড়ে ৫০০ টাকা)।

ইলিশের রাজধানী বলা হয়ে থাকে পদ্মা-মেঘনার মিলনস্থলের জেলা চাঁদপুরকে। এখানকার ইলিশই তুলনামূলক স্বাদ বেশি। জেলার হরিণা মাছঘাটের ইলিশের আড়তদার সিরাজুল ইসলাম সৈয়াল বলেন, এখন এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ২৪শ’ থেকে ২৬শ’ টাকা। আহরণ বাড়লে দাম কিছুটা কমবে। চাঁদপুরের স্থানীয় ইলিশের চাহিদা বেশি থাকার কারণে সব সময়ই দাম একটু বেশি হয়। কারণ হচ্ছে জেলেরা সরাসরি আড়তে নিয়ে আসে ইলিশ। বরফ দেওয়া থাকে না।  

তিনি বলেন, ছোট আকারের ইলিশ পাওয়া যায় বেশি। ওজন ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম। এসব ইলিশ কেজিতে নয়, হালিতে বিক্রি হয়। প্রতি হালি ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর মাঝারি আকারের ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ নেই বললে চলে।

চাঁদপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের পাইকারি ইলিশ বিক্রেতা শামীম হোসেন বলেন, আহরণ কম হওয়ায় স্থানীয় ইলিশের দাম সব সময় বেশি হয়। অবশ্য নোয়াখালী হাতিয়ার ইলিশ প্রতিকেজি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কমে বিক্রি হয়।  

ঢাকার বাজারে ইলিশ যত বড়, তার দর তত বেশি। এখানে সাগর বা কোনো জেলার ইলিশ বলে আলাদা ব্র্যান্ডিং থাকে না। বেশিরভাগ বিক্রেতাই দাম বাড়তি নিতে সব ইলিশকেই পদ্মার বা চাঁদপুরের ইলিশ বলে থাকেন।

ঢাকায় বরিশাল অঞ্চলের এক কেজি ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজনের ইলিশ আড়তে ১৮শ’ থেকে দুই হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এই মাছ খুচরায় ২৪শ’ থেকে ২৬শ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের দর পাইকারিতে ১৪শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা, যা খুচরায় বিক্রি হয় ১৮শ’ থেকে দুই হাজার টাকায়। ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের দর পাইকারিতে কেজি এক হাজার থেকে ১২শ’ টাকা, যা খুচরা বাজারে ১৬শ’ থেকে ১৮শ’ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।  

এছাড়া খুচরায় ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ পাইকারিতে ১১শ’ টাকা কেজি, খুচরায় ১৪শ’ টাকা কেজি এবং ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের ছোট আকারের ইলিশের পাইকারিতে কেজি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে এবং খুচরা বাজারে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।  

অন্যদিকে সাগরের বা চট্টগ্রামের বড় আকারের এক থেকে সোয়া কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮শ’ থেকে দুই হাজার টাকা। ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ১৬শ’ টাকা, ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রামের ইলিশের কেজি ১৩শ’ থেকে ১৪শ’ টাকা এবং ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি এক হাজার থেকে ১৩শ’ টাকা রাখা হচ্ছে। ডিমসহ মাছের দাম এর থেকে কেজিতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কম।

ঢাকায় পৌঁছাতে কোথায় খরচ বাড়ে

ভোলার ইলিশা এলাকার আড়তদার ইউসুফ ব্যাপারী বলেন, প্রতি ঝুড়ি ইলিশ ভোলা থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজার পৌঁছতে ব্যয় হয় সাড়ে তিন হাজার টাকা। ফলে এক কেজি ওজনের এক হালি ইলিশ ঘাটে যদি বিক্রি হয় আট হাজার টাকায়, তাহলে ঢাকায় গিয়ে সেই মাছের দাম বেড়ে হয় ৯-১০ হাজার টাকা।  

চাঁদপুর মাছঘাটের পিউর ইলিশ নামে আড়ত থেকে অনলাইন ও অফলাইন দুইভাবে ইলিশ বিক্রি হয়। এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সুলতান মাহমুদ হাসান বলেন, ইলিশ ৫ থেকে ১০ কেজির মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের যে কোনো স্থানে পাঠাতে কুরিয়ার খরচ হয় ৬০০-৭০০ টাকা। আর পরিমাণ বাড়লে খরচও বাড়বে।

অপরদিকে পটুয়াখালীর আলিপুরের ব্যবসায়ীরা জানান, বরফ, প্যাকেজিং ও লেবার খরচ দিয়ে ঢাকায় পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতি কেজিতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা খরচ যুক্ত হয়।  

যদিও বরিশাল পোর্ট রোডের ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন জানান, কর্কশিট, পলিথিন, বরফ, লেবার খরচসহ এক মণ ইলিশের প্যাকেজিংয়ে ৭৭০ থেকে ৮৫০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এরপর তা সড়কপথে ঢাকার নিউমার্কেট বা কারওয়ান বাজার পর্যন্ত শুধু পৌঁছাতে আরও ৪৫০ টাকা খরচ হয়। দূরত্ব বাড়লে এ খরচ আরও বাড়ে।  

জেলে-বিক্রেতাদের ভাষ্যে চড়া দামের কারণ

বাজারে ইলিশের দাম বৃদ্ধির জন্য চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত আহরণ বা সরবরাহকে দায়ী করছেন জেলেসহ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ইলিশ নদী বা সাগর থেকে বাজারে আনতে খরচের তুলনায় কম ধরা পড়ছে, যেজন্য দাম বাড়ছে।  

বরিশালের মৎস্য ব্যবসায়ী রাজিব শেখ জানান, গত বছর এ সময়ে যে ইলিশ মাছ ছিল বাজারে, এ বছর তাও নেই। কয়েকদিন আগে এর থেকেও খারাপ অবস্থা ছিল, এখন পরিস্থিতির উন্নতি হলেও চাহিদা অনুযায়ী ইলিশের আমদানি এখনও ঘটছে না, তাই বাজারে ইলিশের দামও কমছে না।  

রাজিব শেখ বলছেন, গোটা দেশের পাইকার বাজারে সাগরের মাছ ও স্থানীয় নদীর মাছের দাম আলাদা। সেক্ষেত্রে এখন সাগর থেকে মাছ আহরণ হওয়ায় সেগুলোর দাম কিছুটা কমেছে, তবে আহরণ কম হওয়ায় নদীর মাছের দাম এখনো বেশি। আর সেই সুযোগে অসাধুরা সাগরের মাছ নদীর বলে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে।  

বরগুনা পৌর শহরের খুচরা ইলিশ বিক্রেতা কামাল বাংলানিউজকে বলেন, এখন ইলিশের মৌসুম চলছে। তবে বাজারে যে পরিমাণ মাছ সরবরাহ থাকার কথা সেই তুলনায় অনেকটা কম সরবরাহ হয়েছে ইলিশ। সরবরাহ বেশি থাকলে দাম কিছুটা কম থাকে এবং সরবরাহ কম থাকলে ইলিশের দাম বৃদ্ধি পায়। আর খুচরো বাজারে মাছের দাম নির্ধারণ হয় পাইকারি বাজারের দাম অনুসারে। আশা করি সামনের দিনগুলোতে আরও বেশি পরিমাণ মাছ আহরণ করে বাজারে নিয়ে আসবেন জেলেরা, তখন দামও কমবে।

চাঁদপুর সদর উপজেলার হারিণা ফেরিঘাট সংলগ্ন ইলিশের আড়তদার ইব্রাহীম মিয়া। তিনি বলেন, এ বছর পদ্মা-মেঘনায় বড় আকারের ইলিশ কম ছিল। যার ফলে বছরের শুরু থেকেই এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। এখন ভরা মৌসুমে একই ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৪শ’ থেকে আড়াই হাজার টাকা। যদি স্থানীয় ইলিশের আহরণ বাড়ে তাহলে দাম আরও কমবে।  

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আলীপুর-মহিপুরের ব্যবসায়ীরা বলছেন, যত বেশি সাগরে ইলিশ ধরা পড়বে ততো বাজার দর নিম্নমুখী হবে। মহিপুর আলীপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রাজা মিয়া জানান, জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন মাস ইলিশের ভরা মৌসুম। ইতোমধ্যে মৌসুমের অর্ধেকটা শেষ হলেও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে সাগরে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাননি জেলেরা।  

অপরদিকে ভোলার লালমোহন উপজেলার জেলেরা জানিয়েছেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় আড়তেই দাম বাড়তে থাকে। আর জেলের পর আড়তদার এবং পাইকারসহ কয়েক হাত ঘুরে খুচরো বাজারে গিয়ে ইলশের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।  

তবে মৎস্য অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় দপ্তরের পরিচালক মো. আলফাজ উদ্দীন শেখ বাংলানিউজকে বলেন, আগে মাছঘাটের সংখ্যা নির্ধারিত থাকলেও এখন যেমন জেলের সংখ্যা বেড়েছে তেমনি মাছঘাটের সংখ্যাও বেড়েছে। তাই বড়বাজার বা অবতরণ কেন্দ্রে এখন প্রচুর মাছের দেখা মিলে না, সেজন্য দামও হয়তো কমে না।

মন্তব্য
অনুসন্ধান করুন