ভারতে ক্রিকেট মানেই কোটি মানুষের আবেগ, জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক। যে কারণে ভারত ক্রিকেট দলের জার্সিতে জায়গা পাওয়া যে কোনো ব্র্যান্ডের জন্য স্বপ্নপূরণের মতো ব্যাপার। কোটি দর্শকের সামনে উপস্থাপনা, বিশ্বজুড়ে প্রচারণা—এ যেন ভারতের সবচেয়ে বড় বিপণন মাধ্যম।
কিন্তু দীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষিত বলছে অন্য গল্প। ভারত ক্রিকেট দলের জার্সি স্পনসর হওয়া মানেই যেন এক ধরনের অভিশাপ। একের পর এক ব্র্যান্ড আসে আলো ঝলমলে ঘোষণার মাধ্যমে, কোটি কোটি রুপির চুক্তি হয়। শুরুটা খুব দুর্দান্ত হলেও একটা পর্যায়ে সব যেন ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। কাকতালীয়ভাবে, বিরাট কোহলি-রোহিত শর্মাদের সর্বশেষ ৫টি জার্সি স্পনসরই পড়েছে এমন চক্করে। না, এখানে যে ক্রিকেটারদের বা ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআইয়ের ‘দায়’ বা ‘ভূমিকা’ আছে তা নয়। স্পনসর প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই কেমন যেন অচেনা গর্তে পড়ে যায়।
ভারত ক্রিকেট দলের জার্সি স্পনসর হয়ে ‘অভিশপ্ত’ হয়ে ওঠা সর্বশেষ ব্র্যান্ড ড্রিম ইলেভেন। জনপ্রিয় অনলাইন গেমিং প্ল্যাটফর্মটি ২০২৩ সালে ৩৫৮ কোটি রুপিতে তিন বছরের জন্য ভারত জাতীয় ক্রিকেট দলের জার্সি স্পনসর হয়। তবে সামনে কত দিন থাকতে পারবে এ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

২১ আগস্ট ভারতে অনলাইন গেমিং বিল অনুমোদন পেয়েছে। এতে অনলাইন মানি গেমিং সেবা নিষিদ্ধ হওয়ায় বড় ধাক্কা খেয়েছে ড্রিম ইলেভেন। শুক্রবারই প্রতিষ্ঠানটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, কোম্পানি তাদের সব ধরনের অর্থভিত্তিক প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছে এবং এখন ‘ফ্রি-টু-প্লে’ অনলাইন সামাজিক গেমে রূপান্তরিত হয়েছে। অনেকেরই শঙ্কা, ড্রিম ইলেভেনের কোটি রুপি আয়ে ধস নামতে চলেছে। আর আইনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যশীল কিছু থাকলে বিসিসিআইও নতুন স্পনসরের দ্বারস্থ হবে।
ড্রিম ইলেভেনের আগে ভারত জাতীয় দলের স্পনসর ছিল বাইজুস। ভারতের বহুজাতিক এডুকেশনাল টেকনোলজি কোম্পানিটি ২০১৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত স্পনসর ছিল। এমনকি ফুটবলের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ফিফারও স্পনসর হয়েছিল বাইজুস। তবে প্রতিষ্ঠানটি ঋণ, খেলাপি আর দেউলিয়া হয়ে নাম লিখিয়েছে পতনের খাতায়। ভারতীয় বোর্ড ১৫৮ কোটি রুপি বকেয়ার দাবিতে এনসিএলটিতে মামলাও করেছে। যা এখন ভারতের উচ্চ আদালতে বিচারাধীন।

ড্রিম ইলেভেনের আগে ২০১৭ থেকে দুই বছর ভারতের জার্সি স্পনসর ছিল অপো। চীনা মোবাইল জায়ান্ট কোম্পানিটি ২০১৭ সালে ৫ বছরের জন্য ১,০৭৯ কোটি রুপির চুক্তি করেছিল। তবে মাত্র দুই বছর পরই স্পনসরশিপ ছেড়ে দেয়। ভারতের বাজারে আয়ে ভাটা আর নকিয়া ও ইন্টারডিজিটালের সঙ্গে পেটেন্ট মামলা নিয়ে ঝামেলার সঙ্গে যোগ হয় ভূ-রাজনীতিও। চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্তে উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে বাধ্য হয়েই স্পনসরশিপ ছেড়ে যেতে হয় অপোকে।

২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভারতের স্পনসর ছিল স্টার ইন্ডিয়া। সে সময় ভারতের ম্যাচের সম্প্রচার স্বত্বও ছিল টেলিভিশন কোম্পানিটির কাছে। বছরে ম্যাচ প্রতি ১ কোটি ৯২ লাখ রুপি করে জার্সি স্পনসরশিপ বাবদ দেওয়ার চুক্তি ছিল স্টার ইন্ডিয়া-বিসিসিআইয়ের। তবে ভারতের প্রতিযোগিতা কমিশন (সিসিআই) বিসিসিআই ও স্টার ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতাবিরোধী আচরণের অভিযোগ তদন্ত চালায়। অভিযোগ ছিল সম্প্রচার স্বত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে বাজারে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করা হয়েছিল।

এরপর স্টার ইন্ডিয়া হটস্টারের মতো স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে বিপুল বিনিয়োগ, আইপিএল সম্প্রচার স্বত্ব (২০১৭ সালে ১৬৩৪৭ কোটি রুপি মূল্যে) কিনতে গিয়ে বিশাল ঋণের বোঝায় পড়ে। একপর্যায়ে স্টার ইন্ডিয়ার মূল কোম্পানি টোয়েন্টি ফাস্ট সেঞ্চুরি ডিজনির হাতে চলে যাওয়ায় তাদের অগ্রাধিকারেও পরিবর্তন আসে। যার ফলে ২০১৭ সালে স্টার ইন্ডিয়া ভারতের জার্সি স্পনসরের জন্য নতুন চুক্তিতে জড়ায়নি।
২০০১ সালে ভারতের বহুমুখী ব্যবসায়িক গোষ্ঠী সাহারা ইন্ডিয়া পরিবার মহা সমারোহে ভারতীয় দলের জার্সি স্পনসর হয়। তবে এক দশক যেতে না যেতেই ২০১১ সালে ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবির কঠোর পদক্ষেপে তাদের সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাতা সুব্রত রায়কেও কারাবাস ভোগ করতে হয়। ২০১২ সালে আইপিএলে ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি দিতে ব্যর্থ হয় কোম্পানিটি, যার ফলে বিসিসিআই তাদের ব্যাংক গ্যারান্টি বাজেয়াপ্ত করে। ২০১৩ সালে চুক্তি বাতিল হয়ে যায় এবং স্পনসরশিপেরও ইতি ঘটে।

এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে—বিসিসিআইয়ের জার্সি স্পনসরশিপ আসলে বড় ধরনের জুয়াও। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে ঘিরে যে ঝলমলে গ্ল্যামার, তা ব্র্যান্ডগুলোকে টানে। কিন্তু সেই আলোয় পুড়ে যাওয়া খুব সাধারণ ঘটনা। প্রশ্ন হচ্ছে, পরের টাইটেল স্পনসর কি এই অভিশাপ সামলাতে পারবে?