মূলধন ঘাটতি ৪৬ হাজার কোটি টাকা সম্পদের ৭৮ ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ

코멘트 · 25 견해

লুটপাটের কারণে একীভূতকরণের তালিকায় থাকা বেসরকারি খাতের পাঁচ ইসলামি ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে দেড় লাখ ??

লুটপাটের কারণে একীভূতকরণের তালিকায় থাকা বেসরকারি খাতের পাঁচ ইসলামি ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যা ব্যাংকগুলোর মোট সম্পদের প্রায় ৭৮ শতাংশ। আর মোট সম্পদের ৯৫ শতাংশই আমানতকারীদের অর্থ থেকে বিনিয়োগ করা হয়েছে, যার সিংহভাগই এখন খেলাপি। ঋণের নামে এসব অর্থ ব্যাংক থেকে লুট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এই অর্থ আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। শুধু তাই নয়, মন্দ বিনিয়োগের বিপরীতে দেড় লাখ কোটি টাকার প্রভিশনের চাহিদার বিপরীতে এক টাকাও নেই। ফলে ব্যাংকের সম্পদ পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর সব ধরনের আর্থিক সূচকে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

Advertisement

পাঁচ ব্যাংকের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা হালনাগাদ এক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে উল্লিখিত সব তথ্য। প্রতিবেদনটি গত আগস্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ব্যাংক রেজ্যুলেশন অধ্যাদেশ অনুযায়ী কোনো ব্যাংক বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান অবসায়ন বা একীভূতকরণ করতে হলে সরকারকে জানাতে হয়। পাশাপাশি সরকারের সম্মতিও নিতে হয়। এ কারণেই পাঁচ ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি একীভূতকরণের যৌক্তিকতা তুলে ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অর্থ উপদেষ্টার কাছে একটি চিঠিও দিয়েছেন। অর্থ মন্ত্রণালয় এতে সম্মতি দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদও এতে সম্মতি দিয়েছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই ব্যাংক একীভূতকরণের প্রক্রিয়া শুরু হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, পাঁচ ব্যাংকের মোট সম্পদের পরিমাণ ১ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে দেড় লাখ কোটি টাকাই ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদে পরিণত হয়েছে। এসব সম্পদের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর যেমন কোনো প্রভিশন সংরক্ষিত নেই, তেমনি মূলধন দিয়ে আবৃত কোনো অংশও নেই। উলটো ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পুরোটাই আমানতকারীদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ বিনিয়োগ হিসাবে বিতরণ করা। এর বড় অংশই লুট করেছে এস আলম গ্রুপ, নাসা গ্রুপ ও তাদের সহযোগীরা। লুটের টাকা দেশে রাখেনি তারা। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেগুলো বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিনিয়োগের ৯৮ শতাংশ। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ ১৪ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিনিয়োগের ৯৫ শতাংশ। ইউনিয়ন ব্যাংকের ২৭ হাজার কোটি টাকা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ রয়েছে, যা মোট বিনিয়োগের ৮৯ শতাংশ। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ রয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিনিয়োগের ৬৩ শতাংশ। এই চারটি ব্যাংকই ছিল এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। নাসা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল এক্সিম ব্যাংক। এটির ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা মোট বিনিয়োগের ৪৯ শতাংশ। এসব বিনিয়োগই ইতোমধ্যে আদায় অযোগ্য মন্দ বা কুবিনিয়োগে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী মন্দ বিনিয়োগের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। সে হিসাবে দেড় লাখ কোটি টাকা রাখার কথা। কিন্তু বাস্তবে ব্যাংকগুলোর আর্থিক দুর্বলতার কারণে এর বিপরীতে প্রভিশন বাবদ কোনো অর্থ সংরক্ষণ করতে পারেনি। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মূলধন রাখার কথা। কিন্তু এসব ব্যাংকের কোনো মূলধনও নেই। উলটো ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে বড় অঙ্কের মূলধন ঘাটতি রয়েছে। যা ব্যাংকগুলো পূরণ করা তো দূরের কথা, নিজেরাও দৈনন্দিন কার্যক্রম চালাতে পারছে না, আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। পাঁচটি ব্যাংকই লোকসানে চলে গেছে। ইতোমধ্যে পাঁচ ব্যাংক লোকসান দিয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ও এক্সিম ব্যাংকের লোকসান ৪০০ কোটি টাকার বেশি। গ্লোবাল ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকার বেশি। ইউনিয়ন ও সোশ্যাল ব্যাংকের লোকসান ১০০ কোটি টাকার কম।

এদিকে পাঁচ ব্যাংক একীভূতকরণের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ে দেওয়া এক চিঠিতে গভর্নর বলেছেন, ‘পাঁচ ব্যাংকের সব আর্থিক সূচক নেতিবাচক। চলতে পারছে না। আমানতকারীদের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে। যা দেশের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।’

এই হুমকি মোকাবিলায় আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, আমানতকারীদের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বার্থে টেকসই ঋণপ্রবাহ নিশ্চিত করা জরুরি। এ লক্ষ্যে সরকার প্রণীত ব্যাংক রেজ্যুলেশন অধ্যাদেশ অনুযায়ী এসব ব্যাংককে অতিসত্বর রেজ্যুলেশন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা দরকার।

সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে পাঁচ ব্যাংক একীভূতকরণের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে। এর আওতায় চলতি সপ্তাহেই পাঁচ ব্যাংকের প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে। তাদের সঙ্গে থাকবে একটি চৌকশ দল। যারা প্রশাসকদের সহায়তা করবে। প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকের পর্ষদ বিলুপ্ত করা হবে এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) নিয়োগ বাতিল হয়ে যাবে। প্রশাসকই ব্যাংকের পর্ষদ ও এমডির দায়িত্ব পালন করবেন। এর মাধ্যমে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। এরপর নতুন কোম্পানি গঠন করে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হবে। এর মালিকানায় থাকবে সরকার। সরকার পর্ষদ গঠন ও এমডি নিয়োগ দেবে। সরকারের নামে নতুন শেয়ার ইস্যু করে ব্যাংকের মালিকানা সরকার নেবে। ব্যাংকটি পুরোদমে চালু হলে আগামী দুই বছরের মধ্যে সরকার পর্যায়ক্রমে শেয়ার বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেবে।

সূত্র জানায়, পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ নিয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা, গ্লোবাল ব্যাংক থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে ২৮ হাজার কোটি টাকা, এসআইবিএল থেকে নিয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এক্সিম ব্যাংক থেকে নজরুল ইসলাম মজুমদার নামে-বেনামে নিয়েছেন ১৮ হাজার কোটি টাকা।

একীভূতকরণের পর পাঁচ ব্যাংক পুনরুদ্ধারের যে কৌশল নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার মধ্যে রয়েছে-সরকার থেকে নেওয়া হবে ২০ হাজার কোটি টাকা, আমানতবিমা তহবিল থেকে নেওয়া হবে ১২ হাজার কোটি টাকা, পাঁচ ব্যাংকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ৩ হাজার কোটি টাকার শেয়ার দেওয়া হবে। এভাবে মিলবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। যা থেকে আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধ করা শুরু হবে। পাঁচ ব্যাংকে মোট আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকটি সরকারি মালিকানায় যাওয়ার পর প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের কাছ থেকে আরও আমানত নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে সরকার সহযোগিতা করবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিআরআর ও এসএলআরসহ নীতি সহায়তা দেবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে ব্যাংকটি সরকারি মালিকানায় গেলে এতে আমানতকারীরা আরও বেশি আমানত রাখতে উৎসাহিত হবেন। বিভিন্ন উপকরণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে কর ছাড় চাওয়া হয়েছে। এটি পেলে এ খাত থেকে অর্থ সাশ্রয় হবে। পাঁচ ব্যাংকের গড়ে বিদেশে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক হবে। তা কাজে লাগিয়ে রেমিট্যান্স আহরণ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এতে ব্যাংকে তারল্য বাড়বে। পাশাপাশি আমানতকারীদের টাকা ধীরে ধীরে দেওয়ার সঙ্গে বিনিয়োগও বাড়ানো হবে। বৈদেশিক বাণিজ্য ধরে রেখে আরও শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এসব প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদী কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

코멘트