বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যেখানে সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও পরিবর্তনের ঢেউ একসঙ্গে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্যাংকিং খাত শুধু দেশের অর্থনীতির জন্য নয়, এটি দেশের উন্নয়ন, বিনিয়োগ ও জনগণের আস্থা তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রাখে। এ কারণে একটি দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন বলা হয় ব্যাংকিং খাতকেই। এই ব্যাংকিং খাত যদি ভালো না থাকে, যেকোনো দেশের অর্থনীতি আসলে শেষ পর্যন্ত ভালো করতে পারে না।
এ বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করতেই প্রথম আলো ডটকমের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক টক শো। এতে অতিথি ছিলেন আইএফআইসি ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান মো. মেহমুদ হোসেন; উপস্থাপনায় ছিলেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন। মেহমুদ হোসেন ব্যাংকিং খাতে চার দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশের সাতটির বেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের।
উপস্থাপক শুরুতেই মো. মেহমুদ হোসেনের কাছে জানতে চান তাঁর ক্যারিয়ার সম্পর্কে। উত্তরে মো. মেহমুদ হোসেন জানান, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর ব্যাংকিং পেশাতেই কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৪ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকে যোগ দিয়ে সাড়ে ১০ বছর কাজ করেন। এরপর তিনি যোগ দিন প্রাইম ব্যাংকে। পরবর্তী সময়ে ব্যাংক এশিয়া ও এনআরবি ব্যাংকেও শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বাংলাদেশের প্রায় চারটি প্রজন্মের ব্যাংকের সঙ্গেই কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।
বর্ণাঢ্য এই কর্মজীবনের আলোকে এখন মো. মেহমুদ হোসেন বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে কীভাবে দেখছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আগে থেকেই কিছু পুঞ্জীভূত সমস্যা ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাংকগুলো বিভিন্নভাবে এগুলো লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে গেছে। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে সেই সমস্যাগুলো লুকিয়ে রাখা আর সম্ভব হয়নি। এরপরই আমানতকারী ও জনগণের মধ্যে একধরনের আস্থার সংকট দেখা দেয়। ক্রমান্বয়ে ব্যাংকগুলোর স্বেচ্ছাচার ও বিভিন্ন দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। এই যে আস্থার সংকট, এটিই বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে বড় একটি সমস্যা। এ ছাড়া ২১ শতাংশের বেশি মন্দ ঋণের সঙ্গে জর্জর বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত। আর এসবের মূলে রয়েছে সুশাসনের অভাব।
মো. মেহমুদ হোসেন আরও বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে দক্ষ ও দৃঢ় চরিত্রের নৈতিক মনোবলসম্পন্ন নেতৃস্থানীয় লোকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক শওকত হোসেন জানতে চান, আইএফআইসি ব্যাংক নিয়ে নানা মহলে বিভিন্ন সমালোচনা ছিল। এখানেও একটি গোষ্ঠীর কারণে জনগণের মধ্যে আস্থার একটি সংকট দেখা দিয়েছিল। আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর এই সমস্যাগুলো কতখানি কাটিয়ে উঠেছেন?
উত্তরে মো. মেহমুদ হোসেন বলেন, ‘আপনি যে গোষ্ঠীর কথা বললেন, আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছিল এটি একটি বড় ধরনের শক্তি। আইএফআইসি ব্যাংক বলতেই আগে মানুষ মনে করত, সেই গোষ্ঠী বা একক কোনো ব্যক্তির ব্যাংক। তাঁর ইচ্ছাতেই সব হবে। এ কারণেই ৫ আগস্টের পর মানুষের এই ব্যাংকের প্রতি আস্থার সংকট দেখা দেয়। এমনকি মাত্র তিন মাসের মধ্যেই প্রায় আমাদের ১২ শতাংশ ডিপোজিট চলে যায়। নতুন বোর্ড গঠনের পর আমরা এটি নিয়েই কাজ করতে শুরু করি। আমাদের প্রথম কাজ ছিল তারল্য বজায় রাখা এবং নতুন আমানত সংগ্রহ করা।’ তিনি বলেন, এখন সুশাসন ফেরায় আইএফআইসি ব্যাংকের গ্রাহকদের আস্থাও ফিরেছে।
মো. মেহমুদ হোসেন জানান, ৫ আগস্টের পর তাঁরা তাঁদের কর্মীদের নতুন উদ্যমে কাজের জন্য আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে তাঁরা তাঁদের বিজ্ঞাপনগুলোকে নতুন করে সাজাতে শুরু করেন। এতে করে দেখা যায়, চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে আইএফআইসি ব্যাংক তাদের ৫০ হাজার কোটি টাকার মাইলফলকটি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এ মুহূর্তে আইএফআইসি ব্যাংকের প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকার আমানত রয়েছে।
কথার সূত্র ধরে শওকত হোসেন বলেন, বলা হয়ে থাকে, যেকোনো ব্যাংকের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ যাঁদের মালিকানা, তাঁরাই ব্যাংককে শাসন করেন, বাকি ৯০ শতাংশ কোনো কিছুই বলতে পারেন না। এ সংস্কৃতি থেকে কীভাবে বের হয়ে আসা যায়?
উত্তরে মো. মেহমুদ হোসেন বলেন, ‘ব্যাংক কোম্পানি আইনের সাহায্যে এই সংস্কৃতি পরিবর্তন সম্ভব। এখানে কোনো পরিবার কিংবা গোষ্ঠীর প্রভাব কমিয়ে আনার জন্য কাজ করতে হবে। পরিচালকের মেয়াদ কমিয়ে আনতে হবে, যেন তাঁরা যথেচ্ছাচার করার সুযোগ না পায়। স্বতন্ত্র পরিচালকদের সংখ্যাটিকে বাড়িয়ে দিতে হবে। স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা বেশি হলে তাঁরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেন।’
দেখা যায়, পরিচালনা বোর্ডে যাঁরা থাকেন, তাঁদের হস্তক্ষেপ অনেক বেশি থাকে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী? উপস্থাপকের এ প্রশ্নের উত্তরে মো. মেহমুদ হোসেন বলেন, বোর্ডের সদস্যের নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব রয়েছে। তাঁরা সেগুলো পালন করবেন। আর যাঁরা এমডি রয়েছেন, তাঁদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কিছু গাইডলাইন রয়েছে। তাঁদের উচিত সেগুলো অনুসরণ করা। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক এমডিদের রক্ষাকবচ দিয়ে থাকেন। যাতে তাঁদের কাজে কেউ কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ না করতে পারে।
আলোচনার শেষ পর্যায়ে শওকত হোসেন জানতে চান আইএফআইসি ব্যাংকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে।
মো. মেহমুদ হোসেন বলেন, ‘প্রথম দিকে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল তারল্য বজায় রাখা। নতুন আমানত সংগ্রহ করা। এখন আমাদের মূল পরিকল্পনা হলো, খারাপ ঋণগুলো আদায় করার চেষ্টা করা। পাশাপাশি এ বছরের মে মাস থেকে আমরা নতুন করে ঋণপ্রবাহ ও ঋণ প্রদান কর্মসূচি শুরু করেছি। আমরা এ সময় ক্ষুদ্রঋণ, কৃষিঋণ এবং এসএমই ঋণকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। সেই সঙ্গে আমরা নারীদের জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করছি, তাঁদের নানা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।’
মো. মেহমুদ হোসেন আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে যাঁরা সবজি ও ফল চাষের কাজ করছেন, তাঁদের বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষের প্রশিক্ষণ দিতে আমরা চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে আমরা বিদেশি একটি সংস্থার সঙ্গেও কাজ করছি। এ ছাড়া পরিবেশ নিয়েও আমরা বিভিন্ন ধরনের কাজ করছি।’