পোল্যান্ডে কেমন আছে মুসলমানরা

Comments · 4 Views

ইউরোপের নবম বৃহত্তম দেশ পোল্যান্ড উত্তরে বাল্টিক সাগর, পশ্চিমে জার্মানি, দক্ষিণে চেকোশ্লাভাকিয়া ও পূর্বে সো?

ইউরোপের নবম বৃহত্তম দেশ পোল্যান্ড উত্তরে বাল্টিক সাগর, পশ্চিমে জার্মানি, দক্ষিণে চেকোশ্লাভাকিয়া ও পূর্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি প্রজাতন্ত্রঘেরা একটি দেশ। দীর্ঘদিন সোভিয়েত রাশিয়ার পদানত থাকলেও এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে পোল্যান্ড। দেশটির আয়তন ৩, ১২, ৬৭৯ বর্গ কিলোমিটার। পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ। পোল্যান্ডের জনসংখ্যা ৪ কোটি। অধিকাংশ মানুষ ক্যাথোলিক খ্রিষ্টান। এই হিসাবে, পোল্যান্ড একটি খ্রিষ্টান প্রধান দেশ। 

দেশটির জনগণের ৭১.৩ শতাংশ রোমান ক্যাথলিক ধর্ম বিশ্বাসী। তবে পোল্যান্ডে মুসলিম জনসংখ্যা এক শতাংশেরর নিচে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পোল্যান্ডে মুসলিম জনসংখ্যা মাত্র ৫০ হাজার। এর মধ্যে ৫ হাজার তাতার মুসলমান, বাকি ৪৫ হাজার বিদেশি অভিবাসী ও ধর্মান্তরিত পোলিশ। দেশটিতে অতীতে ইসলামের প্রসার তেমন না ঘটলেও সম্প্রতি সেখানে ইসলাম দ্রুত বিকাশ লাভ করছে বলে জানা গেছে। 

পোল্যান্ডে ইসলামের আগমন ও প্রসার
পোল্যান্ডে ইসলামের আগমন ও প্রসারের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। প্রধানত দুটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশটিতে ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তাতার মুসলমানদের বসতি স্থাপনের মাধ্যমে পোল্যান্ডে ইসলামের সূচনা হয়। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে শুরু করে অভিবাসন এবং ধর্মান্ত্মরের মাধ্যমে পোল্যান্ডে ইসলাম বিস্তার লাভ করে। ত্রয়োদশ শতকে তাতার মুসলমানরা যখন পোল্যান্ডে পা রাখে তখন তারা লিথুনিয়ার গ্র্যান্ড ডাচিতে বসতি স্থাপন করে। জানা যায়, ত্রয়োদশ শতকে মঙ্গোলরা ইউরোপ আক্রমণ করে। তখন তাতার মুসলিম সেনাদের একটি পোল্যান্ড ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। তখনও তারা এ দেশে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করতে পারেনি। স্থায়ী বসতি স্থাপন শুরু হয় চতুর্দশ শতকে।

মঙ্গোলিয়া থেকে আগত তাতার মুসলমানরা মূলত দক্ষ সৈনিক হিসেবে পরিচিত ছিল। তারা ছিল প্রচণ্ড সাহসী জাতি গোষ্ঠী। চতুর্দশ শতকে পোল্যান্ডের রাজা গ্র্যান্ড ডিউক উইহোল্ড এবং পরবর্তী পোলিম রাজারা তাতারদেরকে তাদের সামরিক দক্ষতার জন্য মূল্যবান মনে করত। তখন ডিউক তাতারদের পোল্যান্ডে বসবাস করার অনুমতি লাভ করে এবং সামরিক বাহিনীতে তাতারদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১০৩৯ সালে পোল্যান্ডের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য তাতার মুসলমান সৈনিকরা জার্মানি এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। যুদ্ধে তারা বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখে পোল্যান্ডকে রক্ষার চেষ্টা চালায়। জোসেফ বেন মানে ‘ইউসুফ পাশা’ নামক এক মুসলিম জেনারেল পোলিশ সেনাবাহিনীর অধীনে আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তাতার মুসলিম সেনাদের বীরত্ব এবং সাহসিকতার জন্য পোলিশ রাজারা তাদের প্রতি খুশি হন। তখন তারা এর বিনিময়ে তাতারদের অনেক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। তাদের জমি কেনার অনুমতি দেওয়া হয় এবং তাদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতাও দেওয়া হয়। 

তাতার মুসলমানরা পোলিশ সমাজের সাথে ধীরে ধীরে একাত্ম হতে শুরু করে। তারা পোলিশ ভাষা গ্রহণ করে, পোলিশ রীতিনীতি ও ঐতিহ্য অনুসরণ করে এবং পোল্যান্ডের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রদর্শন করে। তবে তারা কোনোক্রমেই ইসলাম বিশ্বাস এবং স্বতন্ত্র ঐতিহ্য এবং নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে যায়নি। পরবর্তী পর্যায়ে তাতাররা পোলিশ সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অংশ নিয়ে দেশের পক্ষে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখে। 

এদিকে কমিউনিস্ট শাসনামলে উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশ ও বন্ধুভাবাপন্ন আরব দেশের বহু শিক্ষার্থী পোল্যান্ডে গমন করে। এদের অনেকেই ছিল মুসলিম এবং এদের অনেকে পড়াশোনা শেষ করার পর পোল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে বসবাস শুরু করে। আর এভাবে পোল্যান্ডে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। 

১৯৯০ সালে কমিউনিস্ট শাসনের পতনের পর দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয় এবং অভিবাসন আগমন বৃদ্ধির ফলে চেচনিয়া, বসনিয়া, কসোভা, সিরিয়া, ইরাক, বাংলাদেশ এবং অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে আসা মানুষজন পোল্যান্ডে আশ্রয় নেয়। তখন রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে মিসর, ফিলিস্তিন, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, সোমালিয়া, আফগানিস্তান থেকেও মুসলমানরা পোল্যান্ডে উচ্চতর শিক্ষা, উন্নত জীবনের প্রত্যাশা ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি কারণে পোল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে আগমন করে। এর ফলেও দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। 

ইসলাম প্রচার ও প্রসারে মুসলিমদের কর্মতৎপরতা 
মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পোল্যান্ডের প্রধান শহরগুলোতে যেমন ওয়ারশ, ক্রাকো, গদানস্ক, বিয়ালিস্টক শহরে মুসলমানরা মসজিদ এবং ইসলামিক সেন্টার গড়ে তোলে। তখন ধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য মুসলমানরা ‘মুসলিম রিলিজিয়াস অ্যাসোসিয়েশান’, ‘ইসলামিক সেন্টার’ এবং ‘ইসলামি দ্বিনি ইত্তেহাদ’ ইত্যাদি সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। ‘ইসলামি দ্বিনি ইত্তেহাদ’ মক্কাভিত্তিক রাবেতা আল-আলমে ইসলামির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তাদের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে। এর বাইরেও পোল্যান্ডে কাজ করছে আরো অনেক মুসলিম সংগঠন। 

‘পোলিশ মুসলিম ইউনিয়ন’-এর তত্ত্বাবধানে কুরআন, হাদিস, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশের লক্ষ্যে পোলিশ ও ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন ম্যাগাজিন নিয়মিত প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে ‘মুসলিম ওয়ার্ল্ড রিভিউ’ এবং মাসিক ‘আলিফ’ অন্যতম।  

লেখক : শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং সিনিয়র ইসলামি ব্যাংকার।

Comments