এত সাফল্যের পরেও নারী ফুটবল দল কেন বঞ্চিত, সমতা কবে আসবে

Komentari · 3 Pogledi

একই দেশের পতাকা নিয়ে মাঠে নামে দুই দল। ঘাম ঝরায়, জয়ের জন্য লড়াই করে। কিন্তু তারপরও দুই দলের পথ পুরোপুরি আলাদা। ?

একই দেশের পতাকা নিয়ে মাঠে নামে দুই দল। ঘাম ঝরায়, জয়ের জন্য লড়াই করে। কিন্তু তারপরও দুই দলের পথ পুরোপুরি আলাদা। একদল হাঁটে লাল কার্পেট বিছানো রাস্তায়, অন্য দল কাঁটা বিছানো পথে। বাংলাদেশ পুরুষ ও নারী ফুটবল দল যেন বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। যেখানে পুরুষদের জন্য সুবিধা ও সমর্থনের ছড়াছড়ি। তুলনায় নারীরা পান না বলার মতো তেমন কিছু। নারীদের পথচলা বৈষম্য আর অবহেলার বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশ পুরুষদের জাতীয় দল যেখানে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলে যাত্রা শুরু করেছিল, সেখানে নারী দল অপেক্ষা করেছে আরও ৩৭ বছর। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় সাফ নারী ফুটবলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রেখেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ছেলেদের চেয়ে অনেক দেরিতে সূচনার পরও নারীরা যা করেছেন, তা সোনালি অক্ষরে লেখার মতো। পুরুষ ফুটবলের অর্জনের খাতা যদি হয় বিবর্ণ, নারীদের খাতা অনেক উজ্জ্বল।

সাফল্যে অনেকটা এগিয়ে মেয়েরা

অল্প সময় আর সীমিত সুযোগের পরও বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল পুরুষদের চেয়ে কতটা এগিয়ে গেছে, তা পরিসংখ্যানই বলে দেয়।

২০১০ সালে শুরুর পর ২০২৫ সালের এই জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ নারী দল খেলেছে ফিফা–স্বীকৃত ৭০টি ম্যাচ। এর মধ্যে জয় এসেছে ২৮টিতে। জয়ের হার শতকরা ৪০। হার ৩১টি, ড্র ১১টি। অন্যদিকে ২০১০ থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ১৫ বছরে পুরুষ দল খেলেছে ১২৭টি ফিফা–স্বীকৃত ম্যাচ। জয় মাত্র ৩৫টি। শতকরা জয়ের হার ২৭। হার ৬২টি, ড্র ৩০টি।

বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দলের আন্তর্জাতিক সাফল্যের তালিকা খুব দীর্ঘ নয়। একমাত্র এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিয়েছিল ১৯৮০ সালে, কুয়েতে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে। এরপর কেটে গেছে ৪৫ বছর, কিন্তু আর কখনো এশিয়ান ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদার এই আসরে খেলা হয়নি বাংলাদেশের। আন্তর্জাতিক ট্রফির জন্য অপেক্ষাটা দীর্ঘই ছিল। সেই অপেক্ষা খানিকটা ঘোচে ১৯৯৫ সালে, মিয়ানমারে চার জাতি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে শিরোপা জয়ের মাধ্যমে। এটি ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের প্রথম শিরোপা।

এর চার বছর পর ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডুতে সাফ গেমসে প্রথমবারের মতো সোনার পদক জেতে বাংলাদেশ। ওই জয় নতুন স্বপ্ন দেখায় দেশের ফুটবলপ্রেমীদের। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সালে ঘরের মাঠে আয়োজিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হয় লাল-সবুজের দল। এটি ছিল দেশের পুরুষ ফুটবলের সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর একটি।

 
কিন্তু এর পর থেকেই যেন সাফল্যের রাস্তা হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ দল। ২০০৫ সালের পর আর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালেই ওঠা হয়নি। সর্বশেষ ২০২৩ সালে দীর্ঘ ১৪ বছর পর সাফের সেমিফাইনালে উঠে কিছুটা স্বস্তি এনে দেন জামাল ভূঁইয়ারা; যদিও ট্রফির অপেক্ষাটা থেকেই গেছে। সাফের সর্বশেষ শিরোপা জয়ের ২২ বছর পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে অন্য দেশগুলো এগিয়ে গেছে অনেক দূর। কেউ কেউ নিয়মিত এশিয়ান কাপে খেলছে, কেউ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করছে। সেখানে এখনো দক্ষিণ এশিয়ার সীমিত পরিসরেই আটকে আছে বাংলাদেশ।

২০১০ সাল থেকে দক্ষিণ এশিয়ান গেমস (এসএ গেমস) ফুটবলে জাতীয় দল খেলে না, খেলে অনূর্ধ্ব-২৩ দল। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ দল এসএ গেমসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে একবারই, ২০১০ সালে ঢাকায়।

তুলনায় মেয়েদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। বয়সভিত্তিক স্তরে নানা সাফল্যের পর জাতীয় দল গত তিন বছরে দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়েছে। ২০২২ সালে সাফ নারী ফুটবলে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। নেপালের ঘরের মাঠে, দর্শকে ঠাসা গ্যালারিতে সাবিনা-কৃষ্ণারা যা করেছেন, তা বিরাট ইতিহাস। ২০২৪ সালে সেই একই মাঠে একই দর্শকদের কাঁদিয়ে সাফ শিরোপা ধরে রেখেছেন মেয়েরা। ফাইনালে ঋতুপর্ণা চাকমা বাঁ পায়ের দুর্দান্ত গোল করে দলকে আনন্দে ভাসান। বাংলাদেশের ফুটবলে বড় কোনো ট্রফি ধরে রাখার কীর্তির সেটিই একমাত্র উদাহরণ।

নারী ফুটবলের সাফের গণ্ডি পেরিয়ে এসেছে আরও বড় সাফল্য। বাংলাদেশের মেয়েরা এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলেছে দুবার—২০১৬ ও ২০১৯ সালে, যেখানে খেলেছে এশিয়ার সেরা আট দল। ২০২৫ সালের ২ জুন র‌্যাঙ্কিংয়ে ৭৩ ধাপ এগিয়ে থাকা মিয়ানমারকে তাদেরই মাঠে ২-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ফুটবল নারী দল জায়গা করে নিয়েছে এএফসি এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে। আগামী বছর মার্চে অস্ট্রেলিয়ায় এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলবে ১২টি দল। শীর্ষ ছয়ে থাকলে সরাসরি সুযোগ আসবে ২০২৭ ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলার। সাত বা আটে থাকলে থাকবে আন্তমহাদেশীয় প্লে–অফ খেলার সুযোগ। সেই প্লে–অফ জিতলে বিশ্বকাপে ওঠা যাবে।

অথচ মেয়েদের ঘরোয়া কাঠামোয় বিরাট বৈষম্য

একদিকে ছেলেদের জন্য ছকে বাঁধা সূচি, অন্যদিকে মেয়েদের সামনে অনিশ্চয়তার অন্ধকার। বাংলাদেশের পুরুষ ফুটবলে লিগ কবে শুরু, শেষ কবে, কোন মাঠে হবে, কখন হবে স্বাধীনতা কাপ, কখন নতুন চ্যালেঞ্জ কাপ—সবই আগেভাগে জানিয়ে দেয় বাফুফে। বর্ষপঞ্জি থাকে। ২০০৭ সাল থেকে চলছে পেশাদার লিগ। সেই থেকে লিগ হয়ে আসছে প্রতিবছরই। ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া ফেডারেশন কাপ তো আছেই।

২০০৯ সালে চালু হয় ‘সুপার কাপ’, যার চ্যাম্পিয়ন দল পেত এক কোটি টাকা পুরস্কার। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনটি সুপার কাপ হওয়ার পর টুর্নামেন্টটি বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ ১২ বছর পর সুপার কাপ ফিরিয়ে আনা হয়েছে আগামী সেপ্টেম্বরে শুরু হতে যাওয়া ঘরোয়া ফুটবলে। এবার নতুন মৌসুমে রেকর্ড ৫টি ঘরোয়া টুর্নামেন্ট পাবে ছেলেরা—চ্যালেঞ্জ কাপ, লিগ, ফেডারেশন কাপ, স্বাধীনতা কাপ ও সুপার কাপ।

আর মেয়েরা? তাঁদের জন্য কোনো বর্ষপঞ্জিই নেই। কাঠামো নেই। ২০২৪ সালের মে মাসে সর্বশেষ লিগ হওয়ার পর ১৩ মাস পেরিয়ে গেছে। নারীদের জন্য কোনো ঘরোয়া ফুটবল আয়োজন হয়নি। লিগ হয় বছরে একবার, তা–ও খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে। দল আনতে হয় অনুরোধ করে। সর্বশেষ লিগে জাতীয় দলের শীর্ষ ফুটবলাররা কোনো দল পাচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত নাসরিন স্পোর্টিং ক্লাব জাতীয় দলের ১৪ জন খেলোয়াড় নেয়। বাফুফে কর্মকর্তারা জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের ক্লাবটিতে খেলার সুযোগ করে দেন।

সর্বশেষ নারী লিগে খেলেছে ৯টি দল। তাতে ছিল না দেশের শীর্ষ ক্লাবগুলো। নারী ফুটবলে খেলতে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। অন্যদিকে ছেলেদের প্রিমিয়ার লিগে দলের সংখ্যা ১০। ছেলেদের লিগটা পেশাদার, যার দ্বিতীয় স্তর আছে। মেয়েদের একটাই লিগ, এর কোনো স্তর নেই। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) আয়োজনে দেশে নারী লিগ শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে। সে বছর ১৪ অক্টোবর লিগে চ্যাম্পিয়ন হয় শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব। মাত্র ৫০ হাজার টাকা অর্থ পুরস্কার পায় চ্যাম্পিয়নরা, রানার্সআপ পায় ৩০ হাজার। পুরুষ ফুটবলে এই অর্থ পুরস্কার কম করেও ৫ লাখ আর ৩ লাখ টাকা। সারা বিশ্বেই পুরুষ আর নারী ফুটবলচিত্রটা প্রায় একই রকম। তবে বাংলাদেশে নারী ফুটবল একটু বেশিই বঞ্চিত।

গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে নারী ফুটবল লিগ হয়েছে মাত্র ছয়বার। প্রথম দুটি পরপর হয়েছে, তারপর টানা ছয় বছরের বিরতি। ২০১৯ সালে আবার চালু হলেও লিগটা অনিয়মিত, উপেক্ষিত। ২০২৩ সালের মে মাসে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছিল বাফুফে। কিন্তু সেটাও হয়নি।

পারিশ্রমিকে আকাশ-পাতাল পার্থক্য

দু-তিন বছর আগেও শীর্ষস্থানীয় পুরুষ ফুটবলাররা ক্লাব থেকে বছরে ৮০-৯০ লাখ টাকা পর্যন্ত পেয়েছেন। দু-একজন পেয়েছেন কোটি টাকাও। গত বছর ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পালাবদলের পর এই অঙ্ক অনেকটা কমেছে। তারপরও সেটা ৪০-৫০ লাখ টাকার ঘরে আছে। বছরের ক্লাব থেকে ৪০-৫০ লাখ টাকা পাওয়া খেলোয়াড়ের সংখ্যা ১৫-২০ হবে।

২০১৯-২২ পর্যন্ত বসুন্ধরা কিংস যখন নারী ফুটবল লিগে খেলেছে, তখন একজন শীর্ষ নারী খেলোয়াড় পেতেন ৪-৫ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ লিগে খেলেনি কিংস। মেয়েরা নাকি কিংসের কাছে ১৫-১৬ লাখ টাকা চেয়েছিলেন তখন, তাই তারা দল গড়েনি বলে ফুটবল অঙ্গনে আলোচনা আছে। হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হয়ে কিংস নারী ফুটবল থেকে সরে যাওয়ার পর নারী ফুটবলারদের পারিশ্রমিকে ধস নামে। মেয়েরা গত লিগে পেয়েছেন সর্বোচ্চ দু-আড়াই লাখ টাকা।

বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ডালিয়া আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেদের ফুটবলে কয়েকটি স্তর আছে। প্রিমিয়ার, চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ ও পাইওনিয়ার। মেয়েদের ফুটবলে কোনো স্তর নেই। নারী ফুটবলে এটাও বিরাট ঘাটতি। তা ছাড়া লিগে বড় ক্লাব আসে না বলে মেয়েরা বলার মতো পারিশ্রমিক পায় না। গত লিগে (২০২৪) কয়েকটি ক্লাব মেয়েদের পেটেভাতে খেলিয়েছে বলে আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছি।’

সারা বিশ্বেই পুরুষ আর নারী ফুটবলারদের পারিশ্রমিকে বিরাট পার্থক্য আছে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো যা পেয়েছেন ক্লাব থেকে, নারী ফুটবলের সাবেক বিশ্বসেরা সেরা মার্তা দা সিলভা পেয়েছেন তার চেয়ে অনেক কম। কারণ, মানুষের আগ্রহ, স্পনসরশিপ, প্রতিদ্বন্দ্বিতার মান—সবই কম থাকে মেয়েদের ফুটবলে। সে হিসেবে মেয়েদের পারিশ্রমিক কম হবে, এটা বাস্তবতা। কিন্তু বাংলাদেশের মেয়েরা যে পরিমাণ সাফল্য আনেন, সে অনুপাতে তাঁদের প্রাপ্তিটা কম।

এখনো গ্রামগঞ্জে বাধার মুখে পড়ছে মেয়েদের ফুটবল। গত জানুয়ারিতে জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ পণ্ড হয়েছে। একদল ‘বিক্ষুব্ধ মানুষ’ হামলা চালিয়ে খেলার মাঠের বেড়া ভাঙচুর করেছে। এরপর দিনাজপুরের হিলিতে ‘তৌহিদী জনতার’ বাধায় মেয়েদের ম্যাচ পণ্ড হয়। পরে অবশ্য এসব স্থানে পণ্ড হওয়া ম্যাচ হয়েছে সকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে।

বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের নির্দিষ্ট আয় বলতে বাফুফে থেকে পাওয়া মাসিক বেতন। ২০২২ সাফ জেতার পর মেয়েদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের বেতনের আওতায় আনা হয়। কিন্তু বেতন তাঁরা সময়মতো পেয়েছেন কমই। সর্বশেষ গত ৩০ জানুয়ারি ১৮ জন খেলোয়াড় কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পর তাঁদের বাদ দিয়ে ৩৬ জনের সঙ্গে চুক্তি করে বাফুফে। এরপর বিদ্রোহী ১৮ জনের চুক্তিও নবায়ন হয়। তাঁদের মধ্যে ১৩ জনের বেতন ৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৫৫ হাজার করেছে ফেডারেশন। বাফুফের বেতনকাঠামোয় আছেন এখন ৫৪ জন নারী ফুটবলার।
ফুটবল ক্লাবের খেলা। ক্লাব থেকেই ফুটবলাররা টাকা পান। বাংলাদেশে যেহেতু ক্লাব থেকে আয় মাঝেমধ্যে হয় আর তা খুবই সামান্য, তাই বাফুফেই মেয়েদের লালন–পালন করে। কিন্তু ফেডারেশন এখন যা দেয়, তা পর্যাপ্ত নয়। দুই বছর আগে চালু করা হয় ম্যাচ ফি (১০ হাজার টাকা)। সেই টাকাও বকেয়া থেকেছে। বেতন-ম্যাচ ফি সময়মতো না পেয়ে মেয়েরা অসন্তোষ প্রকাশ করেন অনেকবারই।

মেয়েরা গত বছর অক্টোবরে সাফ জেতার পর বাফুফে ঘোষিত দেড় কোটি টাকা পুরস্কার আজও পাননি। অবশ্য ২০২৩ সালের অক্টোবরে মালদ্বীপকে হারানোর পর ছেলেদের ৬০ লাখ দেবে বলেছিল বাফুফে, সেই টাকা ছেলেরাও পাননি। ছেলেদের সেই টাকা পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনাও নেই।

ছেলেরা পাঁচ তারকা হোটেলে, মেয়েরা বাফুফে ভবনে

বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল দেশে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার আগে পাঁচ তারকা হোটেলে থাকে, আর নারী ফুটবলারদের রাখা হয় বাফুফে ভবনের ক্যাম্পেই। এই বৈষম্য বহুদিনের। এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি) বা সাফের টুর্নামেন্টের সময় খরচ দেয় এএফসি-সাফই। কিন্তু বাংলাদেশের মেয়েদের হোটেলে না রেখে ভবনেই রাখা হয়েছে বেশি। এর ব্যাখ্যা একটাই, মেয়েরা নাকি বাফুফে ভবনে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন! তবে ব্যতিক্রমও আছে। দু-তিনবার মেয়েদের হোটেলে রাখা হয়। ঢাকায় চলমান সাফ অনূর্ধ্ব-২০ টুর্নামেন্টে মেয়েদের হোটেলে রাখা হয়েছে।

দুই রকম কোচিং প্যানেল

বাংলাদেশে পুরুষ ও নারী ফুটবল দলের কোচিং প্যানেলে রাতদিন পার্থক্য। পুরুষ দলে বিদেশি কোচে ভরপুর থাকে, মেয়েদের দলে হালে একজন বিদেশি কোচ। তা–ও তাঁকে মেয়েদের দলের জন্য আনা হয়নি। আনা হয়েছিল ছেলেদের একাডেমির জন্য।একাডেমি থেকে সরিয়ে পিটার বাটলারকে করা হয়েছে জাতীয় দলের কোচ।

ছেলেদের জাতীয় দলের জন্য এমনও হয়েছে, মাসে ৪–৫ জন বিদেশি কোচিং স্টাফের জন্য ৩৫-৪০ লাখ টাকাও খরচ হয়েছে। আর মেয়েদের কোচিং স্টাফের জন্য মাসে খরচ হয়নি তিন-চার লাখ টাকাও। ২০২২ সালে সাফ জেতার পর কোচ গোলাম রব্বানীর মাসিক সম্মানী এক লাখের কোটা পেরোয়। গত বছর সাফের আগে পিটার বাটলারকে দেওয়া হয় নারী দলের দায়িত্ব। তিনি মাঠে সফলতা দিলেও পুরুষ দলের কোচ হাভিয়ের কাবরেরার চেয়ে তাঁর বেতন অনেকটা কম। কাবরেরার বেতন মাসে ১৩ হাজার ডলার। বাটলারের ৮ হাজার।

এখনো বাধা আসে নারী ফুটবলে

বাংলাদেশে নারী ফুটবলের প্রথম প্রশিক্ষণ হয়েছিল ১৯৭৮ সালের আগস্টে কোচ সাহেব আলীর অধীন। অল্প কদিন পরই সেই ক্যাম্প বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দীর্ঘ বিরতি। ২০০৩ সালে ফিফা-এএফসির তাগিদ দেয় মেয়েদের ফুটবল চালু না করলে অনুদান বন্ধ করে দেবে। কিন্তু তখন অনেক বাধা পেরোতে হয়েছে। মেয়েদের ম্যাচ বন্ধ করা হয়েছে হামলা করে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ‘ভিশন এশিয়া’ প্রকল্পের অধীন শুরু হয় মেয়েদের ফুটবল।

অল্প দিনেই সাফল্য এনেছেন মেয়েরা। কিন্তু এখনো গ্রামগঞ্জে বাধার মুখে পড়ছে মেয়েদের ফুটবল। গত জানুয়ারিতে জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ পণ্ড হয়েছে। একদল ‘বিক্ষুব্ধ মানুষ’ হামলা চালিয়ে খেলার মাঠের বেড়া ভাঙচুর করেছে। এরপর দিনাজপুরের হিলিতে ‘তৌহিদী জনতার’ বাধায় মেয়েদের ম্যাচ পণ্ড হয়। পরে অবশ্য এসব স্থানে পণ্ড হওয়া ম্যাচ হয়েছে সকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে।

কোথায় হারাল পুরুষ ফুটবলের সোনালি দিন

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ফুটবল ছিল পুরুষদের নিয়ন্ত্রণে। সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত দেশে বিনোদনের বড় মাধ্যম ছিল ফুটবল। তখন পর্যন্ত আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ মানে দেশ ভাগ হয়ে যেত দুই ভাগে। আবাহনী-মোহামেডান—সেই আবেগ হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। ঘরোয়া ফুটবলও হারিয়েছে জৌলুশ।

ঘরোয়া ফুটবল যত পিছিয়েছে, পুরুষ জাতীয় দলের জন্য বাফুফের বিনিয়োগ তত বেড়েছে এবং হতাশ করেছে পুরুষ দল। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হামজা চৌধুরী গত মার্চে বাংলাদেশের জার্সি পরার পর জাতীয় দল নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। এরপর এসেছেন কানাডাপ্রবাসী শমিত সোম, ইতালিপ্রবাসী ফাহামিদুল ইসলাম। কিন্তু এই প্রবাসীদের নিয়ে জাতীয় দল দুটি ম্যাচ খেলেও এখনো জয়ের মুখ দেখেনি। অবশ্য জাতীয় দলে খেলে তাঁরা আর্থিকভাবে কিছু পান না।

উল্টো দিকে মেয়েরা জিতে চলেছেন। তাঁরা মাঠে নামেন আর দেশের মানুষকে ভাসান জয়ের আনন্দে। তাই এখন সময় এসেছে অন্যদিকে তাকানোর। নারী দল যা করেছে, তা শুধু খেলাধুলার জয় নয়, এটি এক জাতীয় গৌরব। তাঁরা যা দিয়েছেন, সমান সুযোগ, সম্মান আর পরিকল্পনা করতে হবে তাঁদের নিয়ে। মেয়েদের চাহিদাগুলো পূরণ করা গেলে তাঁরা একদিন বিশ্বকাপেও নিয়ে যেতে পারেন বাংলাদেশকে।

নারী দল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর দু–একটি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলেও যতটা আশা করা হয়েছিল, তেমন স্পনসর আসেনি। লিগ আয়োজন করতে গেলে দেখা যায় স্পনসর–খরা। পুরুষদের ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরও স্পনসর আসে। মেয়েদের লিগ হয় নামমাত্র বাজেটে। পুরুষ লিগে বাজেট থাকে মেয়েদের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি এবং প্রচারণায়ও অনেক এগিয়ে পুরুষ লিগ।

তারপরও মেয়েরা কীভাবে এত সাফল্য পাচ্ছেন? এই প্রশ্নের একটাই উত্তর, বাংলাদেশ নারী ফুটবলের সাফল্যের পেছনে রয়েছে বাফুফের দীর্ঘমেয়াদি অনুশীলন। ২০১৬ সাল থেকে বাফুফে ভবনে নারী দলকে একটানা নিবিড় আবাসিক অনুশীলনে রাখা হয়েছে। ঘরোয়া লিগ না থাকলেও নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া, ফিটনেস ও ট্যাকটিক্যাল দক্ষতায় এগিয়ে গেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। দক্ষিণ এশিয়ায় এভাবে কেউ নারী ফুটবলারদের একটানা অনুশীলনে রাখে না।

কী করণীয়

নারী ফুটবলের বিকাশের জন্য নিয়মিত ঘরোয়া লিগ আয়োজনের বিকল্প নেই। সঙ্গে যোগ করতে হবে কিছু টুর্নামেন্ট। বেশি বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা মেয়েদের অনেক দিনের দাবি। নারী কোচ ও সংগঠক তৈরি করাও জরুরি। বাফুফের নেতৃত্বে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ালে নারী ফুটবল গতি পাবে আরও।

ছেলেদের ফুটবলে সাবেক তারকারা কোচিং, টেকনিক্যাল কমিটি বা নানা পর্যায়ে যুক্ত হচ্ছেন। কিন্তু নারী ফুটবলে সেই চিত্র নেই। অথচ নারী দলের সাবেক ফুটবলারদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা কাজ করতে চান, অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে প্রস্তুত। তাঁদের সামনে সুযোগ তৈরি করা জরুরি।

এখন মেয়েরা জাতীয় দলে খেললেও তাঁদের বেতন সীমিত। ম্যাচ ফি পান না সময়মতো। খেলোয়াড়ি জীবনে একটি আর্থিক নিশ্চয়তা না থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই পেশায় আসতে আগ্রহী হবে না। বেতন বাড়াতে হবে, ম্যাচ ফি সময়মতো দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, নারী ফুটবলের বাজেট বাড়াতে হবে।

বাফুফে ভবনে এখন মেয়েরা আবাসন–সংকটে গাদাগাদি করে থাকছেন। খাবার, থাকা, চিকিৎসা—এসব মৌলিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া সাফল্য টিকবে না।

নারী ফুটবলে সংগঠকদের মধ্যে অগ্রণী কামরুন নাহার ডানা বাফুফের প্রথম মহিলা ফুটবল কমিটির সম্পাদক ছিলেন। তিনি বলেন, ‘মেয়েরা এত ভালো করছে অথচ তারা সুযোগ–সুবিধা তেমন পাচ্ছে না। লিগের কোনো ধারাবাহিকতা নেই। বড় বড় দল আসে না। ফলে মেয়েরা বলার মতো টাকাও পায় না।’

কামরুন নাহার যোগ করেন, ‘মেয়েরা ঠিকমতো টাকা না পেলে অভিভাবকেরা কেন মেয়েদের খেলায় দেবে? আমি মনে করি, বড় দলগুলো যেন লিগে খেলে, সে উদ্যোগ নিতে হবে বাফুফেকে। জাতীয় চ্যাম্পিয়নসহ আরও প্রতিযোগিতা করতে হবে। শুধু মেয়েদের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে পাঠালে হবে না, ঘরোয়া খেলা আয়োজন করতে হবে। বাড়াতে হবে খেলোয়াড়সংখ্যা।’

সামনে এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে ভালো করতে পারলে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ তৈরি হবে। বিশ্বকাপের স্বপ্ন পূরণ করতে হলে এখনই দরকার শক্তিশালী দলের সঙ্গে প্রস্তুতি ম্যাচ, উন্নত অনুশীলন ক্যাম্প। বাংলাদেশ নারী ফুটবল এখন মোড় ঘোরানোর পথে দাঁড়িয়ে। এই সময়ে যথার্থ বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা না থাকলে অর্জনের সম্ভাবনাও থেমে যাবে।

Komentari
Belal Hossain 1 d

দারুণ উপস্থাপনা--