দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে মোহাম্মদপুরে ব্যবসা করছি। এই এলাকার প্রতিটি গলি, প্রতিটি পরিবর্তন বলতে গেলে আমার চোখের সামনে ঘটেছে। সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছু বদলেছে—মানুষের মুখ, বাজারের ধরন, এমনকি রাজনীতির আবহাওয়াও। তবে একটা বিষয় কখনো বদলায় না, সেটা হলো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা আর সেই প্রত্যাশা পূরণের ঘাটতি।
গত বছরের জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের সময়কার অভিজ্ঞতা আমার স্মৃতিতে এখনো টাটকা। আমি ব্যবসা করি রাস্তার পাশে। সেখানে প্রতিদিন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। আন্দোলনের আগে থেকেই টান টান উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। মানুষ কথা বলছিল, অস্থিরতা বাড়ছিল। তারপর যখন আন্দোলন শুরু হলো, তখন আসলে বোঝা গেল, পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
আমরা যারা প্রতিদিনের খেটে খাওয়া মানুষ, তারা জানি, অস্থিরতা মানে শুধু রাজপথে বিক্ষোভ নয়। অস্থিরতা মানে দোকান বন্ধ, বেচাবিক্রি বন্ধ, পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তা। জুলাইয়ের উত্তাল দিনগুলোতে দোকানের এক পাশ বন্ধ রেখে ব্যবসা করতে হয়েছে। ক্রেতা এসেছে কম। যারা একটু সচ্ছল, তারা হয়তো এক দিন কেনাকাটা না করে থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের মতো মানুষের জন্য এক দিনের ব্যবসা না হওয়া মানে বিরাট ক্ষতি।
আন্দোলনের সময় আমি নিজের চোখে গুলি খাওয়ার ঘটনা দেখিনি, তবে আমার চারপাশে যে আতঙ্ক, সেটা বুঝেছি। ছাত্ররা আন্দোলনে নেমেছে; কারণ, তারা ব্যথিত, তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সেই আন্দোলনে বিরাট প্রত্যাশা নিয়ে জনসাধারণ যুক্ত হলো। স্বৈরাচারের পতন ঘটল। তবে বাস্তবতার কি রদবদল হয়েছে? যে বিরাট প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ আন্দোলন করেছিল, প্রাপ্তির সঙ্গে তার ফারাক অনেক। একটা বিশাল সম্ভাবনার জায়গা অকার্যকর হয়ে গেছে। যে বৈষম্য দূর করার জন্য এত কিছু, সেই বৈষম্য তো থেকে গেছে।
এখন উপলব্ধি করছি, সরকার শুরুতেই ভুল করেছে। তারা ছাত্রদের শ্রেণিকক্ষে ফেরাতে পারেনি। সরকার চাইলে ছাত্রদের সবকিছুতে সরাসরি অংশগ্রহণ না করিয়ে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে রাখতে পারত। সেই সংরক্ষিত শক্তি সরকারকে যেকোনো সংকটে সহযোগিতা করতে পারত। তাতে সরকারের সুবিধা হতো।
জুলাইয়ের আন্দোলন তো ছাত্রদের একার সংগ্রাম ছিল না। তাতে গণমানুষের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। আর স্বাধীনতা তো একবারই হয়। তবে বারবার তার সংস্কার হতে হয়। সেই সংস্কারের জন্যই আন্দোলন হলো। কিন্তু কোনো পরিবর্তন তো এল না। যে সরকার দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের কাছ থেকে আমরা ভিন্ন কিছু পাব বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু মানুষ বলছে, ওরাও তো পুরোনো ধারাতেই চলছে।
আমাদের সমাজে এখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার লোক কেমন যেন কমে গেছে। প্রশাসনের উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে নিচ পর্যন্ত মনে হচ্ছে একটা অদৃশ্য চক্র আছে। সেখানে টাকা, সুবিধা আর গোষ্ঠীগত আনুগত্যই মুখ্য। সুশাসনের কথা বলে যারা আসে, তারাই ক্ষমতায় গেলে আমাদের চোখের সামনেই সেই মূল্যবোধ বিসর্জন দেয়। এভাবে কি দেশ চলে? যে কাজগুলো এখনই করা প্রয়োজন, তা করা হচ্ছে না। যেগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে সবাই পড়ে আছে। সংস্কারের তো শেষ নেই। সেটা তো চলতেই থাকবে। আজকে যে অনিয়মের সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতে যে এখনকার ক্ষমতাবানেরা তার দ্বারা আক্রান্ত হবে না, সে নিশ্চয়তা কোথায়!
ব্যবসার অবস্থা এখন খুবই খারাপ। ক্রেতাদের বড় একটা অংশ আর আসছে না। মানুষের কেনার ক্ষমতা কমে গেছে, আসবে কোত্থেকে? সরকারের কথা শুনলে মনে হয়, সব ঠিক আছে। না, সব ঠিক নেই। দেশ ঠিকমতো চলছে না। আমরা ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে পড়ে থাকছি। কে কী বললেন, কে কাকে অপছন্দ করলেন—সেসব পাশ কাটিয়ে মূল সমস্যাগুলো কেউ যেন স্পর্শই করছেন না—যেমন দুর্নীতি, ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এগুলো নিয়ে যদি সরকার, রাজনৈতিক দল, ছাত্র, পেশাজীবী—সবাই মিলে একসঙ্গে কথা না বলে, না কাজ করে তাহলে এই সমাজ চলবে না।
আমার এখনো প্রত্যাশা আছে। এখনো সময় আছে। যদি সরকার, রাজনৈতিক দল, ছাত্রসমাজ, ব্যবসায়ী সবাই এক টেবিলে বসে—তবে হয়তো নতুন একটা পথ বের করা সম্ভব। তা যদি আমরা না পারি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কিন্তু অন্ধকার। শুধু ক্ষমতার বদল হবে, মানুষের ভাগ্য বদলাবে না। আমরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? না, চাইনি। একটা ঐক্যের বাংলাদেশ গড়ার সময় এখনো আছে, সেই স্বপ্ন নিয়েই আমি এখনো দোকান খুলি, মানুষ দেখি, আশা করি।