আজ যখন আরেক জুলাইয়ে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকাই, অভ্যুত্থানের কথা মনে করি, তখন অনেক স্মৃতিবিস্মৃতির ভিড়ে কেমন যেন ন্যুব্জ অনুভব করি। সম্ভবত সে কারণেই এক বছরে কী আমাদের সামষ্টিক অর্জন, বস্তুনিষ্ঠ বা নৈর্ব্যক্তিকভাবে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা বেশ কঠিন মনে হয়। খুব কাছ থেকে বড় কোনো কিছুকে দেখলে অনেক সময় তাকে তার সমগ্রতায় দেখতে পাওয়া মুশকিল হয়। যাঁরা জুলাই অভ্যুত্থানকে নেতিবাচকভাবে দেখেন, তাঁরাও স্বীকার করবেন যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেওয়া এক বিরাট ঘটনা। তাই নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জুলাইকে বিশ্লেষণ করতে গেলে তা অপূর্ণই থাকবে। সম্ভবত আমরা সবাই অন্ধ হয়ে হাতির বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করছি। মাত্র এক বছরের মাথায় ‘জুলাই আমাদের কী দিল’, এই প্রশ্নের নির্মোহ উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। জুলাই ও তৎপরবর্তী একটা বছর যাদেরকে ক্রমাগত ট্রমা দিয়ে গিয়েছে, তাদের পক্ষে তো আরও নয়। তবু চেষ্টা করা জরুরি, সেই চেষ্টাটাই এই লেখায় করছি।
নানা অভিধায় শেখ হাসিনার শাসনকে অভিহিত করা হয়েছে গত ১৬ বছরে। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, শেখ হাসিনার শাসনামল মূলত ছিল একটা মাফিয়ারাজ। একজন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মাফিয়া তখনই একটা সমাজে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, যখন প্রথাগত প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়। ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ নিজেকে বাঁচাতে তখন মাফিয়ার শরণাপন্ন হতে, তাকে শাসক হিসেবে মেনে নিতে একরকম বাধ্য হয়। সে অর্থে শেখ হাসিনার তুলনা যতটা চলে হিটলার, মুসোলিনির সঙ্গে, তার থেকে বেশি চলে নরিয়েগা বা নায়েব বুকেলের সঙ্গে। শেখ হাসিনা যে বারবার বিবিধ রীতি ও আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পেরেছেন, তা কিন্তু মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশের নীরব সম্মতিতেই। যাঁরা মাফিয়াশাসিত সমাজ ও রাষ্ট্রগুলোর ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছেন তাঁদের জানার কথা, মাফিয়ার পতনের পরবর্তী যে সময়টা, তা সাধারণত হয়ে থাকে সবচেয়ে সহিংস। একটা বিশাল মাফিয়া নেটওয়ার্ক রাতারাতি অকেজো হয়ে গেলে ছোট ছোট গুন্ডা–মাস্তানেরা আঁধার থেকে আলোতে আসে। আর তারপর শুরু হয় দখল নেওয়ার প্রতিযোগিতা। এলাকার বাজার থেকে দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়—কিছুই সেই কাড়াকাড়ির প্রক্রিয়ার বাইরে থাকে না। ফলে গত এক বছরে এই দখলের প্রতিযোগিতায় সহিংসতা যে চরম পর্যায়ে পৌঁছাবে, এটা আমাদের অনুমান করতে পারা উচিত ছিল। মনে রাখা দরকার ছিল, আওয়ামী লীগের বাইরে বাকি সবাই গৌতম বুদ্ধ হলে শেখ হাসিনার আপাদমস্তক অগণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে এত অনায়াসে এত বড় অংশের মানুষের নীরব সম্মতি উৎপাদন করা সম্ভব ছিল না।
অকার্যকর পুলিশের শূন্যস্থান পূরণ করতে ব্যারাকের সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের দেওয়া হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা। এই আয়োজন কত দিনের জন্য? অনন্তকাল ধরে সেনাবাহিনী দিয়ে দেশ চালানোই কি অভ্যুত্থানের চেতনা? আমাদের নতুন কর্তাদের এসব প্রশ্ন করলে কোনো স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় না। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই নাজুক। একদিকে দিন–দুপুরে হত্যা-ছিনতাই-রাহাজানি নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে, উল্টো দিকে একধরনের ছদ্ম সেনাশাসনের ভেতর আমরা বাস করছি। এহেন পরিস্থিতিতেই বহু মানুষের মনে মনে উচ্চারিত হচ্ছে সেই নিষিদ্ধ বাক্য, ‘আগেই কি তবে ভালো ছিলাম।’
অভ্যুত্থানের পর থেকেই আমাদের একটি ন্যারেটিভ গেলানো হয়েছে। তা হলো, আমরা ভারতের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়েছি, এ জন্য ২০২৪ আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই আজাদির লক্ষণগুলো ঠিক কী? একদিকে আমরা দেখছি, সেই আগের মতোই একদিকে সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিক বিএসএফের গুলিতে মরছে, অন্যদিকে চলছে রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে মোদিকে আম পাঠানোর কূটনীতি। যে সরকার স্রেফ ‘পরিবেশ রক্ষার্থে’ সেন্ট মার্টিনকে সারা দেশ থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন করে বহু মানুষের জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলেছে, সেই সরকারের কেউ রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে একটা শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। আগের মতোই ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে আমরা আদানির থেকে বিদ্যুৎ আমদানি জারি রেখেছি। উল্টো দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যাতে বাড়তি শুল্ক দিয়ে আমাদের পণ্য রপ্তানি করতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে গোপন চুক্তির আশ্রয় নিচ্ছে আমাদের সরকার। সেই নন–ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট রাজস্ব বোর্ডের একজন সচিব প্রকাশ করে দেওয়ায় তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হচ্ছে। ঔপনিবেশিক আইনে তাঁর বিরুদ্ধে করা হচ্ছে মামলা। ট্রাম্পের মাস্তানির কাছে গোপনে আত্মসমর্পণ করা জাতি যখন ‘গোলামি না আজাদি’ স্লোগান দেয়, তখন তা স্রেফ কথার কথায় পরিণত হয়।
দরকার ছিল আসলে একটা অথেনটিক প্রগতিশীল শক্তি। যে শক্তি একাত্তর ও চব্বিশকে একসঙ্গে ধারণ করে বলতে পারবে, এই দেশ যতটুকু মুসলমানের, ততটুকুই হিন্দুর; যতটুকু পুরুষের, ততটুকুই নারীর; যতটুকু মালিকের, ততটুকুই শ্রমিকের। প্রশ্ন হলো, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা পরানোর মানুষ কোথায় পাই!
বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের পর থেকে শতাধিক মাজার যে ভেঙেছে, সে কথা সরকার নিজেই স্বীকার করেছে। মজার বিষয় হলো, এই সরকারের একজন উপদেষ্টাকে আমি চিনি, যিনি তাঁর ছাত্রজীবনের একটা বড় সময় আমাদের এই জ্ঞান দিয়ে গেছেন যে বাংলাদেশের যাবতীয় সামাজিক সংকটের বড় কারণ হলো, একদিকে আছে ইসলামবিদ্বেষী তথাকথিত প্রগতিশীলেরা, অন্যদিকে আছে ‘বাংলার মুসলমানদের’ ঘৃণা করা তথাকথিত ইসলামিস্টরা। এই দুইয়ের হেজিমনিতে বাংলার নিজস্ব ইসলাম বিপন্ন হয়েছে। যতই অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকুন তিনি, তাঁর শাসনামলে যে বাংলাজুড়ে মাজার ভাঙার মহোৎসব চলল, আমি জানি না তিনি ইতিহাসের কাছে এর কী জবাব দেবেন। মানুষকে ‘শাতিম এ রাসুল’ ট্যাগ দিয়ে কী কী অনাচার গত এক বছরে চলেছে, তা নিয়ে আলাদা করে কিছু বলতেও চাই না। বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আতঙ্কিত, এ কথা অস্বীকার করলে মিথ্যাচার হবে। পুলিশের অবর্তমানে নীতি পুলিশের দাপট বেড়েছে বহুগুণ। ভিন্নমত ও ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে মানুষ সমাজে কোণঠাসা হচ্ছে, এই সত্যটুকু স্বীকার না করতে পারলে আমরা কোনো সমাধান খোঁজাও শুরু করতে পারব না।
২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনেও ছাত্ররা আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু সে স্ফুলিঙ্গ থেকে যে দাবানল তৈরি হয়নি তার একটা বড় কারণ হলো, সেবার শ্রমজীবী মানুষ ব্যাপকভাবে রাজপথে নেমে আসেননি। যে শ্রমিকশ্রেণি অকাতরে ২০২৪ সালে শাসকের গুলির সামনে বুক পেতে দিল, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা পেয়ে সবার আগে গুলি করল তাদের বুকেই। এ ঘটনাগুলো আমাদের মধ্যে যতটুকু ক্রোধের উদ্রেক করে, ততটুকুই লজ্জার।