বনবিবির কাহিনি ও লোকবিশ্বাসঃ
বনবিবিকে সুন্দরবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে মানা হয়। স্থানীয় লোককথা ও পুরাণ অনুসারে, তিনি জঙ্গল রক্ষাকারী ও বাঘের আক্রমণ থেকে মানুষের সুরক্ষাকারী। বনবিবির সঙ্গে আরও যে কাহিনিগুলি যুক্ত রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দুখে নামের একটি দরিদ্র ছেলের গল্প, যে বনবিবির কৃপায় জীবিত ফিরে এসেছিল। এইসব কাহিনির উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বনবিবি পূজার প্রচলন।
মেলার আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতাঃ
মাঘ মাসের প্রথম দিনে খুলনার কয়রা উপজেলার চরামুখা গ্রামে বনবিবির মন্দির প্রাঙ্গণে মেলার আয়োজন করা হয়। এদিন হাজারো মানুষ ভিড় করে মন্দির প্রাঙ্গণে। পূজা, পুঁথিপাঠ, প্রসাদ বিতরণ ও দুধ-ভাতের ভোগের মাধ্যমে বনবিবির আরাধনা হয়। বনের নিরাপদ যাত্রা ও জীবিকা নির্বাহের আশায় মানুষ এই পূজায় অংশ নেয়।
মেলার পরিবেশ আনন্দমুখর ও উৎসবমুখর। গ্রামের মাঠজুড়ে বসে গ্রামীণ হাট। পাওয়া যায় হস্তশিল্প, মাটির তৈজসপত্র, বাঁশের তৈরি জিনিস, দেশি মিষ্টান্ন এবং শিশুদের খেলনা। নাগরদোলা, বাঁশি, পুতুলনাচ, সার্কাস প্রভৃতি বিনোদনও থাকে মেলার বিশেষ আকর্ষণ।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও সামাজিক গুরুত্বঃ
বনবিবির মেলা ধর্মীয় সীমারেখা অতিক্রম করে একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এখানে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ই সমানভাবে অংশগ্রহণ করে। এটি স্থানীয় সংস্কৃতি ও সামাজিক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ। মেলায় লোকশিল্প, হস্তশিল্প, খেলনা, মাটির তৈজসপত্রসহ নানান ঐতিহ্যবাহী পণ্যের সমাহার ঘটে। শিশুদের জন্য থাকে নাগরদোলা, পুতুলনাচ, আর বড়দের জন্য গ্রামীণ যাত্রাপালা ও নাটক।
ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাঃ
এই মেলার ইতিহাস বহু পুরনো। ১২৮৩ বঙ্গাব্দ থেকে চরামুখা গ্রামে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, অর্থাৎ এটি প্রায় ১৪৩ বছরের পুরোনো এক ঐতিহ্য। এত দীর্ঘ সময় ধরে একটি মেলা টিকে থাকা, এবং আজও মানুষের মধ্যে আগ্রহ ও শ্রদ্ধা বজায় রাখা, নিঃসন্দেহে এর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব প্রমাণ করে।
‘বনবিবির মেলা’ শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; এটি সুন্দরবনের মানুষের আশা, বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই যারা বন থেকে জীবিকা নির্বাহ করে, তাদের জীবনে এই মেলার বিশেষ অর্থ রয়েছে। বনবিবির প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে তারা বনের প্রতি তাদের সমবেদনা ও নির্ভরশীলতাও প্রকাশ করে। এই মেলা তাই প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের এক চমৎকার উদাহরণ।