কল্পবিজ্ঞানের মতো মনে হলেও, এখন আর তা কল্পনার জগতে সীমাবদ্ধ নেই। প্রযুক্তির বিকাশে আজকের বাস্তবতায় এআই ভয়েস ক্লোনিং বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে কণ্ঠস্বর হুবহু অনুকরণ করার সক্ষমতা আমাদের সামনে এক নতুন যুগের দরজা খুলে দিয়েছে।
কিন্তু এই দরজার ওপাশে কি শুধু সম্ভাবনার আলো, নাকি প্রতারণার অন্ধকারও অপেক্ষায়?
কী এই ভয়েস ক্লোনিং?
ভয়েস ক্লোনিং হচ্ছে এমন একটি এআই প্রযুক্তি, যা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের অডিও শুনেই কোনো ব্যক্তির কণ্ঠস্বর, উচ্চারণ, আবেগ এবং টোন হুবহু নকল করে নতুন বাক্য তৈরি করতে পারে। এটি মূলত ডিপ লার্নিং অ্যালগরিদম ও নিউরাল নেটওয়ার্কস ব্যবহার করে শেখে, এবং ফলস্বরূপ, তৈরি হয় এমন একটি ‘কৃত্রিম কণ্ঠ’, যা সহজে আসল-নকল পার্থক্য করা প্রায় অসম্ভব করে তোলে।
ব্যবহার কীভাবে হয়?
ভয়েস ক্লোনিং প্রযুক্তি ইতোমধ্যেই ব্যবহার হচ্ছে: বিজ্ঞাপন ও অডিওবুক তৈরি, সিনেমা বা নাটকে প্রয়াত অভিনেতার কণ্ঠ ফিরিয়ে আনা, ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট উন্নয়ন, স্পিচ থেরাপি বা ভাষা শিক্ষা। কিন্তু সমস্যাটা তৈরি হয়, যখন এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় প্রতারণার উদ্দেশ্যে।
ভয়েস ক্লোনিংয়ের ভয়াবহ দিক
যেমন প্রতিটি প্রযুক্তিরই দ্বিমুখী দিক থাকে, ভয়েস ক্লোনিংও তেমন। তবে এর নেতিবাচক দিকগুলো অনেক বেশি বিপজ্জনক, কারণ কণ্ঠস্বরই আমাদের অন্যতম একটি পরিচয়—যা বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করে। নিচে ভয়েস ক্লোনিং-এর সম্ভাব্য ক্ষতিগুলোর একটি তালিকা দেওয়া হলো:
১. ব্ল্যাকমেইল ও প্রতারণা
ভয়েস ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে সহজেই তৈরি করা যাচ্ছে ফেইক অডিও—যেখানে কেউ যেন তার পরিবারের সদস্যকে ফোন করে বলছে, “আমি বিপদে পড়েছি, টাকাটা এখনই পাঠাও। ” এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন ইতোমধ্যেই ইউরোপ ও আমেরিকায় বহু মানুষ।
২. রাজনৈতিক বিভ্রান্তি ও ষড়যন্ত্র
রাজনৈতিক নেতাদের ভুয়া অডিও তৈরি করে ছড়িয়ে দেওয়া হতে পারে, যাতে তারা রাষ্ট্রবিরোধী কথা বলছেন—এমন বিভ্রান্তি তৈরি করে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা যায়।
৩. মিথ্যা প্রমাণ আদালতে
ভবিষ্যতে কেউ যদি কোনো অপরাধমূলক কথোপকথন “প্রমাণ” হিসেবে উপস্থাপন করে, এবং সেটা ভয়েস ক্লোন হয়—তাহলে সত্য-মিথ্যার সীমারেখা কোথায় দাঁড়াবে?
৪. সাইবার জালিয়াতি ও ব্যাংক প্রতারণা
অনেক ব্যাংক ও মোবাইল অ্যাপ এখন ভয়েস রিকগনিশনের মাধ্যমে সুরক্ষা দেয়। ভয়েস ক্লোনিং প্রযুক্তি দিয়ে এসব সিস্টেমে ভুয়া কণ্ঠ ব্যবহার করে পাস হওয়া সম্ভব।
কারা ব্যবহার করছে এ প্রযুক্তি?
অপরাধী চক্র ও হ্যাকাররা: বিশ্বজুড়ে সাইবার অপরাধীরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে মানুষকে বোকা বানিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতে। সম্প্রতি হংকংয়ে এক বহুজাতিক কোম্পানির প্রধান নির্বাহীর ক্লোন ভয়েস ব্যবহার করে প্রায় ২৫ কোটি টাকা আত্মসাত করা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও মনিপুলেটিভ গ্রুপ: ভিন্ন দেশ বা দলকে বিব্রত করতে, গুজব ছড়াতে অথবা যুদ্ধসদৃশ পরিস্থিতি তৈরি করতেও ভয়েস ক্লোনিং একটি সম্ভাব্য হাতিয়ার হয়ে উঠছে।
রাজনৈতিক পক্ষ ও প্রপাগান্ডা গোষ্ঠী: নির্বাচনের সময়ে নেতাদের নামে ভুয়া বক্তব্য ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য ভয়েস ক্লোনিংকে 'টোপ' হিসেবে ব্যবহার করার নজির মিলেছে ইতোমধ্যেই।