বজ্রপাত আটকাতে বাঁশের খুঁটি, তামার তার দিয়ে স্কুল ছাত্ররা যে যন্ত্র বানিয়েছে

commentaires · 5 Vues

পশ্চিমবঙ্গের কৃষক পঞ্চানন মণ্ডল সোমবার দুপুরে যখন কথা বলছিলেন, তখন তিনি কর্ণাটকের একটা জমিতে ধান রুইছিলেন।

কর্ণাটকের জমিতে কাজ করতে করতেই মি. মণ্ডল বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "এখানেও মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে, বাজ পড়ছে। যদি দেশে আমার জমিতে যে যন্ত্র আছে, সেটা যদি এই জমিতেও থাকত, নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারতাম।"

 

তার নিজের প্রায় আড়াই বিঘা জমি আছে সুন্দরবন ঘেঁষা গোসাবার বিপ্রদাসপুর গ্রামে। কয়েক বছর আগে তার জমিতে একটা বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র বসিয়েছেন।

 

বাংলাটা যদি একটু অপরিচিত লাগে, তার জন্য বুঝিয়ে দিই, এটার ইংরেজি হল 'লাইটনিং অ্যারেস্টার', বজ্রপাত হলে যে দণ্ডটির মাধ্যমে অতি উচ্চমাত্রায় ধেয়ে আসা বিদ্যুৎ ভূমিগত করে দেওয়া হয়।তবে বাজারচলতি যেসব লাইটনিং অ্যারেস্টার পাওয়া যায়, সেগুলির থেকে মি. মণ্ডলের চাষের ক্ষেতে বসানো যন্ত্রটি অনেকটাই ভিন্ন – একেবারে দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি, এবং সস্তা।উত্তর ২৪ পরগণা জেলার এক স্কুল শিক্ষক ও তার ছাত্ররা কয়েক বছর আগে এই যন্ত্র বানিয়েছেন অ্যালুমিনিয়াম পাত, তামার তার আর একটি বাঁশের খুঁটি দিয়ে।

 

পরপর কয়েকবার স্কুল পর্যায়ের স্থানীয় ও জাতীয় বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে ওই যন্ত্র দেখানোর পরে ওই শিক্ষক ব্যাঙ্গালোরের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ গবেষণা কেন্দ্র থেকে পরীক্ষাও করিয়ে এনেছেন।

 

ওই শিক্ষক, মি. পশুপতি মণ্ডল বিবিসিকে বলছিলেন, "আমিও ছিলাম সেদিন পরীক্ষাগারে। কয়েক মিলি-সেকেন্ডের মধ্যে দেখলাম প্রায় এক লক্ষের বেশি ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে গেল আমাদের তৈরি যন্ত্রটার মধ্যে দিয়ে।"

 

ওই বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্রই কৃষক পঞ্চানন মণ্ডল তার চাষের জমিতে লাগিয়েছেন। তার দেখাদেখি গ্রামে মোট ১৬-১৭টি তড়িৎ-সঞ্চালক বসিয়েছেন অন্য কৃষকরা।

 

যে প্রতিষ্ঠান ভারতে সমস্ত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে সনদ দিয়ে থাকে, সেই সেন্ট্রাল পাওয়ার রিসার্চ ইন্সটিটিউট এই যন্ত্রটি পরীক্ষা করে কার্যকারিতার বিষয়ে সনদ দিয়েছে।পঞ্চানন মণ্ডল বলছিলেন, "এই তো কদিন আগে খবর পেলাম আমাদের কাছের এক গ্রামে একজন মানুষ বাজ পড়ে মারা গেছেন, দুটো গরুও মরেছে। তবে কর্ণাটক থেকে ফিরে গিয়ে নিজের জমিতে যখন ধান রুইব, তখন আমি নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারব।"

 

শুধু তার পাশের গ্রামের একজন মানুষ নয়, গত বৃহস্পতিবার একদিনের বজ্রপাতে গোটা পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলি হিসাব দিয়েছে।

 

পরিবেশ সংক্রান্ত পত্রিকা 'ডাউন টু আর্থ' এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, "ভারতের ১২টি রাজ্যে ২০২৫ সালের মার্চ থেকে ১৭ই এপ্রিল পর্যন্ত ১৬২ জন বজ্রপাতের আঘাতে মারা গেছেন।"

 

গত বছর ওই একই সময়কালে সংখ্যাটা ছিল ৫৭। 'ডাউন টু আর্থ' লিখেছে একবছরে ১৮৪ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছে। এর মধ্যে ১৪২ জন মারা গেছেন এবছরের এপ্রিলের প্রথম ১৭ দিনেই।

 

উত্তর ২৪ পরগণা জেলার 'সোদপুর দেশবন্ধু বিদ্যাপীঠ (বালক)' -এর পদার্থবিদ্যার শিক্ষক ড. পশুপতি মণ্ডল বলছিলেন, "যারা বজ্রপাতে নিহত হন, তাদের বেশীরভাগই প্রান্তিক মানুষ – কৃষক আর মৎস্যজীবী। বর্ষাকালেও যাদের মাঠে ঘাটে কাজ করতে হয় বা মাছ ধরতে হয়। অথচ বজ্রপাত থেকে এদের কোনও নিরাপত্তা নেই। বাজ কিন্তু শহরাঞ্চলের থেকেও বেশি গ্রামের দিকেই পড়ে – যেখানে এইসব প্রান্তিক মানুষ থাকেন। গত সপ্তাহে যারা মারা গেছেন পশ্চিমবঙ্গে, তারা কিন্তু সবাই কৃষক।''

 

"সেই থেকেই আমার মাথায় চিন্তা ঢোকে যে এদের জন্য কম খরচে কীভাবে লাইটনিং অ্যারেস্টার বানানো যায়," বলছিলেন মি. মণ্ডল।

 

অনেক গবেষণা পত্র পড়ে তার মনে হয়েছিল যে সাইকেলের রিম দিয়ে এরকম বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র বানানো যায় কী না।

 

তবে প্রথমে যে যন্ত্রটি বানিয়েছিলেন, পরে তা অনেকবার পরিমার্জিত হয়েছে।

commentaires