ঠিক ৪১ বছর আগে ১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট, বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটেছিল সবচেয়ে বড় বিমান দুর্ঘটনা। তীব্র ঝড়, বৃষ্টি ও বজ্রপাতের মধ্যে পড়ে তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করতে গিয়ে এফ-২৭ বিমান রানওয়ের অদূরে বাউনিয়া বিলের মধ্যে বিধ্বস্ত হয়। এতে দুই পাইলট, তিন ক্রু ও ৪৪ জন যাত্রীসহ ৪৯ জনের সবাই মারা যান। ওই ঘটনায় প্রাণ হারান দেশের প্রথম নারী পাইলট সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানা। হৃদয়স্পর্শী সেই বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে আজকের ফিরে দেখা।
কী ঘটেছিল সেদিন
দিনটি ছিল রোববার। তারিখের হিসাবে ১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা ঘটে সেদিন। চট্টগ্রাম থেকে ৪৪ জন যাত্রী নিয়ে বিজি-৪২৬ নম্বরের ফ্লাইটটি ঢাকায় জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের চেষ্টা করে। বিমানটি ছিল ফকার ফ্রেন্ডশিপ বা সংক্ষেপে এফ-২৭ । ওই সময় আবহাওয়া ছিল দুর্যোগপূর্ণ। শ্রাবণ মাস থাকায় সকাল থেকেই বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। বিমানটি চালাচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন কায়েস আহমদ মজুমদার, সঙ্গে ছিলেন কো-পাইলট সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানা। প্রচুর বৃষ্টির মধ্যে বেলা আড়াইটার দিকে বিমানটি দুই দফা অবতরণ করতে ব্যর্থ হয়। পরে তৃতীয় দফার চেষ্টায় ২টা ৩৫ মিনিটের দিকে রানওয়ে থেকে কিছুটা দূরে অবতরণ করতে গিয়ে বাউনিয়া বিলের মধ্যে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। শুধু তা–ই নয়, বিমানটি প্রায় ২০ থেকে ২৫ ফুট পানির গভীরে ডুবে যায়। মৃত্যু হয় হতভাগ্য ৪৪ যাত্রী, দুই পাইলট, তিন ক্রুসহ ৪৯ জনের। অর্থাৎ দুর্ঘটনায় কেউ বেঁচে ছিলেন না। যাত্রীদের মধ্যে একজন ব্রিটিশ, একজন জাপানি ও বাকিরা বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন। জানা যায়, যাত্রীদের বেশির ভাগ মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার জন্য একটি সংযোগ ফ্লাইট ধরতে ঢাকায় আসছিলেন। এটিই বাংলাদেশের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বিমান দুর্ঘটনা। বিমানটির ৪৪ যাত্রীর মধ্যে ১২ জন মাসকাট, ১০ জন দুবাই ও আবুধাবি এবং একজন বাহরাইন যাওয়ার যাত্রী ছিলেন। তাঁরা ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার হিসেবে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসছিলেন।

পত্রিকার পাতায় বিমান দুর্ঘটনার খবর
১৯৮৪ সালের ৫ আগস্টের মর্মান্তিক ওই বিমান দুর্ঘটনার খবরটি বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল। ঘটনার দুই দিন পর ৮ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাক লিড নিউজ করে। তাদের শিরোনাম ছিল, ‘বিধ্বস্ত বিমানের ৪৭ আরোহীর লাশ উদ্ধার’। পত্রিকাটির খবরে জানা যায়, জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রায় ৫০০ গজ উত্তর-পশ্চিমে বাউনিয়া বিলে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। ইত্তেফাক বিধ্বস্ত এফ-২৭ বিমানের ছবি ছাপে। দুর্ঘটনার পর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই বিষয়েও আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। দুই পাইলট ও তিন কেবিন ক্রুর ছবি দেওয়ার পাশাপাশি নিহত ব্যক্তিদের সবার নামসহ তালিকা প্রকাশ করে ইত্তেফাক।
১৪ আগস্ট দৈনিক সংবাদ বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে সংবাদ প্রচার করে। তাদের শিরোনাম ছিল, ‘বিমান বিধ্বস্ত: ৪৯ জন আরোহীর সবাই নিহত’। তারা বিমানের ক্যাপ্টেন কায়েস আহমদ মজুমদার, ফাস্ট অফিসার কানিজ ফাতেমা রোকসানা, ফ্লাইট স্টুয়ার্ড জাকির হোসেন, ফ্লাইট স্টুয়ার্ড আমিরুল হক ও প্যান্ট্রিম্যান মো. আবদুল গফুরের ছবি ছেপেছিল। সংবাদের খবরে বলা হয়, জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অদূরে বাউনিয়া ঝিলে বেলা ২টা ৩৫ মিনিটে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে বিমানটি দুবার অবতরণের চেষ্টা করে। তৃতীয় দফায় অবতরণের জন্য কন্ট্রোল টাওয়ারের কাছ থেকে নির্দেশ পাওয়ার পরই বিমানটির সঙ্গে কন্ট্রোল টাওয়ারের বেতার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয় যায়। বিধ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিমানটি টুকরা টুকরা হয়ে যায় এবং মূল অংশটি ঝিলের ২০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়।
বাংলাদেশ অবজারভারও বিমান বিধ্বস্তের ছবি দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছিল।

কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছিল
ইত্তেফাকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই সময় ঢাকা ও আশপাশের এলাকার ওপর দিয়ে প্রবল বর্ষণ হচ্ছিল। বিধ্বস্ত হওয়ার আগে বিমানটি দুবার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের চেষ্টা করে। তৃতীয় দফার চেষ্টায় অবতরণের জন্য কন্ট্রোল টাওয়ারের কাছ থেকে নির্দেশ পাওয়ার পরই বিমানটির সঙ্গে কন্ট্রোল টাওয়ারের বেতার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পত্রিকাটি জানায়, বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে বিমানটি কুর্মিটোলায় অবতরণ করতে না পারার একমাত্র কারণ। অন্য কোনো কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হলে ফ্লাইট রেকর্ডার বা বিমানের ‘ব্ল্যাকবক্স’ উদ্ধার করা প্রয়োজন। ৭ আগস্ট পর্যন্ত বিধ্বস্ত হওয়া বিমানের ‘ব্ল্যাকবক্স’ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বিমানের ‘রাডার’ ওই দিন কাজ করছিল না বলেও জানায় ইত্তেফাক। তাদের রিপোর্ট বলছে, ফকার বিমানটিতে মাঝেমধ্যেই যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিত।

প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে বিমান দুর্ঘটনা
বাংলাদেশ বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন (অব.) শেখ নাসির উদ্দীন আহমেদ কানিজ ফাতেমা রোকসানার সহকর্মী ছিলেন। ক্যাপ্টেন নাসির বিমানে চাকরি নেন ১৯৭৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর ক্যাডেট পাইলট হিসেবে। আর কানিজ ফাতেমা রোকসানা ক্যাডেট পাইলট হিসেবে বিমানে ঢোকেন ১৯৭৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর।
শেখ নাসির প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৮৪ সালের আগস্টে আমি এফ-২৮ বিমানের ক্যাপ্টেন ছিলাম। ৫ আগস্ট দুপুর ১২টায় আমার “ঢাকা টু সিলেট” ও “সিলেট টু ঢাকা” ফ্লাইট ছিল। আর রোকসানার ফ্লাইট ছিল দুপুরে “ঢাকা টু চিটাগং” ও “চিটাগং টু ঢাকা”। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় আমাদের দুজনেরই ফ্লাইট ছাড়তে দেরি হচ্ছিল। এই সুযোগে আমি বিমানের ক্রু রেস্টরুমে যাই একটু বিশ্রাম নিতে। গিয়ে দেখি, সেখানে কানিজ ফাতেমা রোকসানা বিশ্রাম নিচ্ছেন। খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে আমি কীভাবে সিলেট যাব, ওই বিষয়ে সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমিও তাঁর চট্টগ্রামের ফ্লাইট সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। যেহেতু রোকসানা ওই সময় তিন মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলেন, তাই তিনি আমাকে বলছিলেন যে ওই দিনের (৫ আগস্ট) পর তিনি আর বিমান চালাবেন না, ছুটিতে যাবেন।’

রোকসানা ছিলেন এফ-২৭ বিমানের ফার্স্ট অফিসার বা কো-পাইলট। আর ক্যাপ্টেন নাসির ছিলেন এফ-২৮ বিমানের পাইলট। ঘটনার দিন এফ-২৭–এর মূল পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন কায়েস আহমদ মজুমদার। খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে ফ্লাইট নিয়ে চট্টগ্রাম যেতে ক্যাপ্টেন নাসির তাঁকে (কায়েসকে) নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন কায়েস তাঁর কথা শোনেননি। পরে ক্যাপ্টেন নাসির দুপুরের ১২টার কিছু পরে ফ্লাইট নিয়ে সিলেট চলে যান। অন্যদিকে ক্যাপ্টেন কায়েস ও ফার্স্ট অফিসার রোকসানা খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেই চট্টগ্রামের উদ্দেশে ফ্লাই করেন।
সিলেট থেকে ফ্লাইট নিয়ে ঢাকার কুর্মিটোলায় ফেরার পর ক্যাপ্টেন নাসির দেখেন, ফকার মানে এফ-২৭ বিমানটি রানওয়েতে অবতরণের চেষ্টা করছে, কিন্তু প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে পারছে না। পাইলট প্রথমে রানওয়েতে অবতরণের চেষ্টা করেন। কিন্তু রানওয়ে স্পষ্ট দেখা না যাওয়ায় এবং পাইলট যখন বুঝতে পারেন যে তিনি সঠিক জায়গায় অবতরণ করতে পারছেন না, তাই বিমানটিকে অবতরণ না করে তিনি চলে যান।
কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় দফায় বিমানটি রানওয়েতে অবতরণের চেষ্টা করে। নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে বিমানের পাইলটকে রানওয়েতে অবতরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু তীব্র বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়ার কারণে বিমানটির অবতরণের চেষ্টা আবারও ব্যর্থ হয় এবং বিমানটি আবারও ঘুরে চলে যায়।

ক্যাপ্টেন নাসির প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফকার-২৭ বিমানটি ঝড়ের মধ্যে ল্যান্ড করতে পারল কি না, কিছুক্ষণ পর তা জানার চেষ্টা করি। আমি একজন সহকর্মীকে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের মাধ্যমে ওই বিমানের সবশেষ অবস্থা জানাতে রিকোয়েস্ট করি। তখন লুঙ্গি পরা একজন মানুষ এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের কাছে এসে বলে যে রানওয়ে থেকে একটু দূরে উত্তর-পশ্চিম বাউনিয়ায় পানির মধ্যে একটি বিমান আছড়ে পড়েছে। প্রথমে ওই লোকের কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায়নি। পরে বিমানের লোকজন খোঁজ নিয়ে দেখে যে এফ-২৭ বিমান অবতরণ করতে গিয়ে বাউনিয়া বিলের পানিতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে। ধারণা করা হয়েছিল, প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের দায়িত্বে থাকা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা বিমানটিকে নোটিশ করতে পারেননি।’
বিমান দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব ছিল বলে মনে করেন, বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন (অব.) শেখ নাসির উদ্দীন আহমেদ।
এফ-২৭ বিমান কোত্থেকে এল
এভিয়েশন ও ট্যুরিজমবিষয়ক সংবাদপত্র ‘বাংলাদেশ মনিটর’-এর সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম প্রথম আলোকে জানান, ‘আমি যত দূর জানি, ১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট দুর্ঘটনায় পড়া ফকার ২৭ বিমানটি ১৯৭১ সালে হল্যান্ডে তৈরি। ভারত সরকার হল্যান্ড থেকে বিমানটি কিনেছিল। পরে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার বঙ্গবন্ধু সরকারকে বন্ধুত্বের নিদর্শন ও বাংলাদেশ বিমানের সক্ষমতা বাড়াতে এই উড়োজাহাজটি উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ বিমান এফ-২৭ বিমানটি এক যুগের মতো ব্যবহার করতে পেরেছিল।’ মানের দিক থেকে ফকার বিমান বিশ্বমানের উল্লেখ করে ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা বেশি দিন বিমানটি থেকে সার্ভিস নিতে পারিনি।’
নিহত যাত্রীদের তালিকা
ফকার-২৭ বিমান দুর্ঘটনায় দুই পাইলট, দুই ফ্লাইট স্টুয়ার্ড ও একজন কেবিন ক্রু এবং ৪৪ জন যাত্রীর সবাই মারা যান। হতভাগ্য যাত্রীরা হলেন সামসুল হক, এম এন এইচ শাফরী, গোলাম রব্বানী, খুরশীদুল আলম, তসলিম উদ্দিন, আবদুল রব্বান, নূর আহমেদ, এস আলম, এ হালিম, আবদুল করিম, এন আলম, ইলিয়াস মিয়া, ইদ্রিস মিয়া, রাজা মিয়া, মোহাম্মাদ হারুন, এম এম এম ভূঁইয়া, আবদুস সোবহান, আবুল হাসেম, অধীর চন্দ্র ঘোষ, এম এইচ উদ্দিন, এ আহমেদ, নূরুল হক, এম আহমেদ, নূর মওলা, রাজেন্দ্র লাল দাসগুপ্ত, সিরাজউল্লাহ, এম চৌধুরী, বি আলম, এম এ রহমান, আহমেদ সাফা, কবির হোসেন, টি কে ঘোষ, এস মাহমুদ, ফরিদুল্লাহ চৌধুরী, আর আমিন, এস এ খান, ডি কে বড়ুয়া, এম আলী, এস এম এস এ চৌধুরী, মিসেস এস এল নেসা, মিস্টার সিনোটসুকা (জাপানি), মিস্টার হোমস (ব্রিটিশ), মুসলিম এ গফ্ফার, এ কাশেম এবং এ গফুর।

তদন্ত কমিটি গঠন
মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনার চার দিন পর ১০ আগস্ট কুর্মিটোলা এলাকার বাউনিয়া বিলের আনুমানিক ২৫ ফুট পানির নিচ থেকে উদ্ধারকর্মীরা বিমানের ‘ব্ল্যাকবক্স’ উদ্ধার করতে সমর্থ হন। পরে ঘটনার তদন্তে সামরিক সরকারের নির্দেশে উইং কমান্ডার (অব.) এস ডব্লিউ নবীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
নৌবাহিনী প্রধানের মৃত্যু
বিমান দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজের সময় ঘটে আরেক হৃদয়স্পর্শী দুর্ঘটনা। উদ্ধারকাজ দেখতে বাউনিয়া বিলে গিয়েছিলেন তৎকালীন নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান। দুর্ঘটনার কারণে কোনো কোনো যাত্রীর শরীর থেঁতলে গিয়েছিল। অনেকের মুখমণ্ডল বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। এটি দেখে নৌবাহিনী প্রধান সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, উদ্ধারকাজ তদারকের সময় মাহবুব আলী খান ভোররাতের দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ৬ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টায় তিনি মারা যান। ৭ আগস্ট বনানী সামরিক কবরস্থানে পূর্ণ সামরিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে দাফন করা হয়।

উদ্ধারকাজ নিয়ে অসন্তুষ্টি ও ক্ষোভ
বিমান দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজে অংশ নিতে নৌ কমান্ডোদের চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনা হয়। তাঁরা রোববার সন্ধ্যা থেকে কাজ শুরু করেন। পরে সেনাবাহিনী ও বিআইডব্লিউটিএ উদ্ধারকাজে অংশ নেয়।
পাইলট কানিজ ফাতেমা রোকসানার স্বামী সৈয়দ হাছান বাকের মারা যান ২০১২ সালে। তাঁর একমাত্র ছেলে সৈয়দ শোয়েব হাছান সুইডেনে থাকেন স্থায়ীভাবে। রোকসানার বাবার পরিবারেরও কেউ দেশে থাকেন না।
রোকসানার স্বজন সুস্মিতা শারমিন সপরিবার থাকেন সুইডেনে। সেখান থেকে টেলিফোনে প্রথম আলোর সঙ্গে বিমান দুর্ঘটনা ও উদ্ধারকাজ নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি জানান, ‘প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে পানির মধ্যে দুর্ঘটনায় পড়া ফকার বিমানটি উদ্ধার করতে অনেক সময় লেগেছিল।’ সুস্মিতা শারমিন কষ্ট নিয়ে বলেন, ‘রোকসানা আপাদের দুর্ভাগ্য, দুর্ঘটনার পরপরই তাঁদের উদ্ধারে কাজ শুরু হয়নি। আবহাওয়া খারাপ থাকায় পরদিন সকালে উদ্ধারকাজ শুরু হয়েছিল। ওই বিমানের কেউ কিন্তু আগুনে পুড়ে মারা যাননি। বেশির ভাগ যাত্রী পানির ভেতরে অক্সিজেনের অভাবে দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। আবার অনেকে বিধ্বস্তের পর বিমানের ভেতরে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মারা গেছেন। বিমানের ধ্বংসাবশেষ বাউনিয়া বিলের পানির মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে পড়ে ছিল। এ জন্য কাউকেই জীবিত অবস্থায় বের করতে পারেনি। বৈরী আবহাওয়ার কারণে উদ্ধারকারীরা আহত পাইলট, ক্রু ও যাত্রীদের দ্রুত বের করে আনতে পারেনি।’

পাইলট ও ক্রুদের কবর কোথায়
ফকার-২৭ বিমান দুর্ঘটনায় নিহত পাইলট কায়েস আহমদ মজুমদার, কো-পাইলট সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানা, দুই ফ্লাইট স্টুয়ার্ড জাকির হোসেন ও আমিরুল হককে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। সেখানে তাঁদের পাশাপাশি কবর দেওয়া হয়েছে। কবরগুলো অযত্নে-অবহেলায় পড়ে আছে। কানিজ ফাতেমা রোকসানা ও আমিরুল হকের কবরের নামফলক পড়া গেলেও বাকি দুজনের নামফলক অযত্নে মুছে গেছে। বাইরে থেকে কেউ এসে বুঝতেও পারবে না এই কবরে সাহসী বৈমানিকেরা শুয়ে আছেন।
বনানী কবরস্থানের সহকারী বেলাল হোসেন জানান, তাঁর বাবা ১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট বিমান দুর্ঘটনায় নিহত দুই বৈমানিক ও তিন ক্রুর দাফন দিয়েছিলেন।
ফ্লাইট স্টুয়ার্ড জাকিরের একমাত্র কন্যা কখনো বাবাকে দেখেননি
বিমান দুর্ঘটনায় অন্যদের সঙ্গে মারা যান ফ্লাইট স্টুয়ার্ড জাকির হোসেন। দুর্ঘটনার মাত্র সাত মাস আগে তিনি বিয়ে করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী রাশিদা খানম ছিলেন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীর মৃত্যুর পাঁচ মাস পর রাশিদার কোলজুড়ে আসে কন্যাসন্তান, নাম তার জেসমিন জাকিয়া। প্রথম আলোকে জেসমিন বলেন, ‘আমার এমনই দুর্ভাগ্য যে আমি কোনো দিন বাবাকে দেখিনি, বাবার আদর-ভালোবাসা পাইনি, তাঁর কোলেও কোনো দিন ওঠার সৌভাগ্য হয়নি।’ তিনি জানান, বাবার মৃত্যুর সময় মায়ের বয়স ছিল মাত্র ২৫-২৬–এর মতো। বাবার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রাখতে মা আর কোনো দিন বিয়ে করেননি। ভোলায় নানাবাড়িতে থেকে তিনি নীরবে নিভৃতে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। এ কথা বলার সময় জাকিয়ার কণ্ঠ ধরে আসে।
বিশ্লেষকের ভাষ্য
স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত বৈমানিক ক্যাপ্টেন (অব.) আলমগীর সাত্তার, বীর প্রতীক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু ৫ আগস্ট ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল, তাই এফ-২৭ বিমানের পাইলটদের উচিত ছিল কুর্মিটোলায় ল্যান্ড করার চেষ্টা না করে চট্টগ্রাম অথবা যশোরে গিয়ে ল্যান্ড করা। তাহলে ওই দুর্ঘটনা হয়তো এড়ানো যেত।’ সাবেক এই বৈমানিক বলেন, ‘ওই সময় আমাদের আধুনিক যন্ত্রপাতি ও দক্ষ উদ্ধারকর্মীর অভাব ছিল। তাই দুর্ঘটনার পর দ্রুততার সঙ্গে বিমানটির পাইলট, ক্রু ও যাত্রীদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে দুর্ঘটনাকবলিত বিমানের সবাই কিন্তু মারা গেছে।’