বড় ছেলে আবদুল্লাহ বিন জাহিদ (১৬) গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাতে। বড় ছেলের মৃত্যুর ঠিক দুই সপ্তাহ পর ফাতেমা তুজ জোহরা জানতে পারেন, ছোট ছেলে মাহমুদুল্লাহ বিন জিসান (১৪) ক্যানসারে আক্রান্ত। সাত মাস পর হারান স্বামীকেও। এই শহীদ জননীর জীবনের গল্প শুনে অনুলিখন করেছেন মো. জান্নাতুল নাঈম।
৫ আগস্ট, আনুমানিক বেলা ৩টা। সন্তানসহ আমি তখন আমার মায়ের বাসায়। আবদুল্লাহর মামা, মানে আমার ভাই ১০০ টাকা দিয়ে ওকে আলু আনতে নিচে পাঠায়। ৩৫ টাকা বেঁচে যাওয়ায় বাসায় এসে আমাকে সেটা ফেরত দেয়। সেদিন আমার মা রান্না করেছিল ইলিশ মাছ। কাঁটা বাছতে পারবে না, তাই আমি ওকে ভাত-ইলিশ খাইয়ে দিই। ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে শেখ হাসিনার পতনের খবর।
আবদুল্লাহ ওর মামার কাছে মিষ্টি খাওয়ার আবদার করে। মামা বলে, মিষ্টিও খাওয়াব, বিরিয়ানিও খাওয়াব।
বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে আবদুল্লাহ আনন্দমিছিলে যাওয়ার আগ্রহ জানিয়ে আমাকে বলে, ‘আম্মু, ৩৫ টাকা যে আছে, ওইটা কি নিয়ে যাব?’
সন্ধ্যায় ফেরার শর্ত দিয়ে অনুমতি দিই। পরে ওর বন্ধুর কাছে শুনেছি, বাসা থেকে বেরোনোর পর একটা কেক কিনে খেয়েছিল। সঙ্গের বন্ধুকে নাকি বলেছিল, ‘আগে মারা গেলে তো নাম (শহীদের সম্মান) পাইতাম, এখন তো আর পাব না।’
সন্ধ্যা ৭টা ৩৬ মিনিটের দিকে আবদুল্লাহর সঙ্গে ফোনে কথা হয়। বলি, ‘বাবা, সন্ধ্যা কী হয় নাই?’
ও উত্তর দেয়, ‘আম্মু, এয়ারপোর্টের মাথায় আছি। আধা ঘণ্টার মধ্যে আসতেছি।’
এটাই শেষ কথা। রাত ৮টা ১০ মিনিটে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে। ওই ব্যক্তি জানান, আবদুল্লাহ গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তাকে নেওয়া হয়েছে রাজধানীর উত্তরা মা ও শিশু হাসপাতালে। আরও কয়েকবার ফোন আসে।
রাত ৯টার দিকে যখন হাসপাতালে পৌঁছাই, আমার ছেলে তখন আর দুনিয়ায় নেই। চিকিৎসককে নিজের নাম আর ফোন নম্বর বলতে পেরেছিল। চিকিৎসকই আমাকে ফোন করেন। আবদুল্লাহ নাকি বারবার বলছিল, ‘আমি আর বাঁচব না। আমার আম্মু আসলেই ঠিক হয়ে যাব।’
উত্তরার এপিবিএনের (আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ন) সদরদপ্তরের উল্টো দিকে প্রথম গুলিটা আবদুল্লাহর গলায় লাগে। এটা দেখে ওর বন্ধু ভয়ে এক ঘণ্টা দৌড়েছে। পরে আমার বাবার (আবদুল্লাহ) সেই বন্ধুটি বলেছে, সে মনে করেছিল ওর বন্ধু ওখানেই মারা গেছে। হাসপাতালে কে নিয়েছে, সেটা সে জানে না।
সংসারটাই এখন ছন্নছাড়া
আবদুল্লাহ বিন জাহিদ ছিল সবার আদরের। বিশেষ করে আবদুল্লাহর চাচা–ফুফুরা ওকে অনেক আদর করতেন। সবাই দেশের বাইরে থাকায় ভাতিজার জন্য অনেক কিছু পাঠাতেন। বলতেই পারি, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমার ছেলেকে দেশের কাপড় পড়তে হয়নি। অথচ সেই আত্মীয়দের সঙ্গে এখন যোগাযোগ নেই বললেই চলে। বিদেশ থেকে এলেও খোঁজ নেন না। কারণ, আবদুল্লাহর মৃত্যুর পুরো দোষটাই তাঁরা আমাকে দিয়েছেন। আমি কেন বাইরে বের হতে দিয়েছি!
তখন থেকে স্বামীর সঙ্গেও তৈরি হয়েছিল দূরত্ব। আবদুল্লাহর বাবা এমনিতেই অন্তর্মুখী মানুষ ছিলেন। প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথা বলতেন না। জুলাই-আগস্টে তিনি পারিবারিক কাজে গ্রামে ছিলেন। সন্তান মারা যাওয়ার পর শুধু বলেছিলেন, ‘তোমার কাছে বড় ছেলেকে রেখে আসলাম, তুমি রাখতে পারলা না।’
আমি অবশ্য মাফ চেয়ে নিয়েছি। আবদুল্লাহ মারা যাওয়ার পর ওদের বাবা বোবা হয়ে গিয়েছিলেন। নামাজ পড়ে এলাকার দোকানে বসে কান্নাকাটি করতেন। এ বছরের মার্চ মাসে তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
আমার সংসারটাই এখন শেষ হয়ে গেছে। দিন শেষে মনে হয়, সবকিছুর বিনিময়ে যদি আবদুল্লাহকে ফিরে পেতাম। আমার আর জিসানের জীবন এখন অন্ধকার।
‘শেখ হাসিনার নামা ছাড়া আর উপায় নাই’
পুরো সময়ই আন্দোলনে সক্রিয় ছিল আবদুল্লাহ। ১৯ তারিখ উত্তরা আজমপুরে আটকা পড়েছিল। তবে আমার চেয়ে জিসানের সঙ্গেই এসব বিষয়ে বেশি কথা বলত। কী কী হয়েছে, সেটা জানাত। ৩ বা ৪ আগস্ট কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আবদুল্লাহ, শেখ হাসিনা কি নামবে?’
সে উত্তর দিয়েছিল, ‘আম্মু, শেখ হাসিনার নামা ছাড়া আর উপায় নাই।’
আমি বলি, ‘আমার তো বিশ্বাস হয় না।’
আবদুল্লাহ বলেছিল, ‘না আম্মু, এবার তাঁকে নামতে হবে।’
আগস্টের ১ তারিখ আন্দোলনে বের হয়েছিল আবদুল্লাহ। ওর বন্ধুর কাছে জেনেছি, ৩ তারিখ বের হয়ে র্যাবের হাতে মার খায়। ৪ তারিখে সে কপালে ব্যথা পায়। পরে ওর বন্ধুদের পাঠানো আরেকটা ছবিতে দেখেছি, ওর কপাল/মাথা আঘাতে রক্তাক্ত। তবে এটা কবে ঘটেছিল, সেটা জানতে পারিনি।

আবদুল্লাহর শেষ ২৪ ঘণ্টা
আমরা তখন আশকোনার আমতলা এলাকায় থাকতাম। ১০ মিনিটের হাঁটার দূরত্বেই ছিল আমার মায়ের বাসা। যেখান থেকে সে আনন্দমিছিলে যায়।
৫ আগস্ট সকাল ৮টার দিকে আবদুল্লাহ ঘুম থেকে ওঠে। এক–দেড় ঘণ্টা মোবাইলে গেম খেলে। ওকে পরোটা আনতে বললাম। ও না গিয়ে জিসানকে পাঠাল। নাশতায় পরোটা আর চা খেয়েছিল। এরপর সাড়ে ১১টার দিকে নিচে গিয়ে প্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যেই আবার বাসায় ফেরে। এরপর আমার পায়ের ওপর শোয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে যায়। ওরা দুই ভাই আমার পায়ের ওপর মাথা রেখে শুতো।
এরপর ঘুম ভাঙিয়ে আমরা ওদের মামার বাড়ির দিকে রওনা হই। জিসান সব সময় পরিষ্কার–পরিপাটি থাকতে পছন্দ করে। রাস্তায় কাদাপানি থাকায় আবদুল্লাহ খুনসুটি করে জিসানকে বলে, ‘এখন তো বাসায় গিয়ে ভিমবার, সার্ফ এক্সেল দিয়ে হাত–পা ধুবি।’ বলেই দুজনের কী হাসি!
আবদুল্লাহ আশকোনাতেই বড় হয়েছে। তাই চায়ের দোকানের লোকজন থেকে শুরু করে সবাই ওকে চিনত। অনেক চঞ্চল আর বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি করত। ওর এক জগতে ছিলাম আমি আর জিসান, আরেক জগতে ওর বন্ধুরা। এখনো ওর অনেক বন্ধু ওর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে মেসেজ দেয়, ‘তোর কাছে মাফ চাওয়ার সময় পাইনি, মাফ করে দিস।’
৫ আগস্ট দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে ওর নামাজে জানাজা হয়। এত রাতেও প্রায় তিন শর মতো মানুষ হয়েছিল। শিক্ষকই ছিলেন ১৫ জন। আমার ভাইয়েরা বলে, ভাগনেকে যে মানুষ ভালোবাসত, এটাই তার প্রমাণ।
আমি রাগ করলে আম্মু-মা ডাকত
পড়াশোনার বাইরে ভালো কাপড় ও খাবারে আগ্রহ ছিল আবদুল্লাহর। কষ্টের কথা হচ্ছে, আমার ছেলে হঠাৎ করেই বড় (উচ্চতায়) হয়ে গিয়েছিল। এই লম্বা ছেলেকেও গোসল করিয়ে দিতাম। কাপড় ধুইয়ে দেওয়া, নখ কাটা, চুলে শ্যাম্পু করা—সবই করিয়ে দিতাম।
আমি রাগ করলে কথা বলা বন্ধ করে দিতাম। তখন আবদুল্লাহ এসে ‘আম্মু-মা’ বলে ডাকত। বলত, ‘তুমি রাগ করছ দেখে দুইবার করে মা ডাকতেছি।’
এখন আর মানুষটাই নেই, যার সঙ্গে রাগ করব, যে আম্মু-মা ডাকবে। সে কোনো কিছু চাইলে, একটু জেদ করত, ‘আম্মু, দাও না। আমি না চাইলে কে চাইবে। আমি তো তোমার সন্তান।’
‘কালকে দেব’ বললে একটু পরপর বলত, ‘কালকে দিবা তো? কখন দিবা, কয়টায় দিবা?’
ও মাংস, আলু ও ডিম খেতে খুব পছন্দ করত। ঘরে ঢুকেই আমাকে খুঁজত, কী রান্না করেছি। বিরিয়ানি রান্না করতে বলা, কোচিং থেকে এসে কফি চাওয়ার মানুষটা আর নেই। মনের কষ্টের কথা বলারও মানুষ নেই। ওর একটা কাবলি সেট (পাঞ্জাবি) আছে। সেটা আর ধুইনি। এখনো ওর বালিশটা নিয়ে ঘুমাই।
গত রমজান মাসে ওর জন্য অনেক কেনাকাটা করেছিলাম। স্যান্ডো গেঞ্জি ছাড়া পরনের পাঞ্জাবি, টুপি, শার্ট, প্যান্ট, ঘড়ি, জুতাসহ সবকিছুই কিনে দিয়েছি। কে জানত, এটাই হবে ওর জন্য শেষ কেনাকাটা।
আবদুল্লাহ কম পড়লেও যতটুকু পড়ত মনোযোগ দিয়ে পড়ত। ভালো ছাত্র ছিল। শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণিতে পড়ত। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, উচ্চমাধ্যমিকের পর ওকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেব।
জিসানের জন্যই বেঁচে থাকা
১৯ আগস্ট জিসানের ক্যানসার ধরা পড়ে। তৃতীয় ধাপে ছিল। তাই কেমোথেরাপি দিয়েই শুরু করতে হয়েছিল। ইতিমধ্যে জিসানের পেছনে প্রায় ৪৭–৪৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আমার তো এখন কিছুই নেই। আমার ভাইয়েরা নিজেদের সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করেছে।
কয়েকটি সংগঠনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। কিন্তু চিকিৎসা খরচের তুলনায় তা অনেক কম। বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি ও ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসা হয়েছে।
দুটি সার্জারি হয়েছে। আরও সার্জারি লাগবে কি না, সেটা পরবর্তী রিপোর্টে জানা যাবে। তবে কেমোথেরাপি লাগবে। তবে সে আগের থেকে ৮০-৮৫ ভাগ সুস্থ। কিন্তু বাকি খরচ মেটানো আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। জিসানের জন্য এখনো অনেক কিছু করতে হয়, চলতে–ফিরতে হয়। কিন্তু আমি নিরুপায়। জানি না, এক সন্তান ও স্বামীকে হারিয়ে অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে বাকিটা পথ কীভাবে পাড়ি দেব!