৫০ জনের সিন্ডিকেটে নকল ওষুধের বাজার

注释 · 22 意见

জীবন রক্ষাকারী ভেজাল ও নকল ওষুধ খেয়ে কিডনি, ক্যানসারসহ নানা ধরনের রোগে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী লোকজন ব্যাপক

পুরাতন ঢাকার মিটফোর্ডে ওষুধের বৃহত্তম মার্কেট অবস্থিত। সেখান থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে বেশির ভাগ ওষুধ পাইকারি ক্রয় করে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা। মিটফোর্ড ওষুধ মার্কেটে অর্ধশতাধিক ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ বাজারজাত নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। একাধিক ব্যবসায়ী এ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, এই সিন্ডিকেট নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন এবং বাজারজাত করে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। জেনেশুনে এ জঘন্য কাজ করা হত্যাকাণ্ডের সমান অপরাধ বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন এবং বাজারজাতকারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব র‍্যাবকে দেওয়ার সুপারিশ করেছেন অনেকেই।

 

ওষুধ বিক্রয়, বিতরণ ও সংরক্ষণের দায়িত্ব ফার্মাসিস্টদের। রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় ৯০ ভাগ দোকানে ফার্মাসিস্ট নেই। বছরের পর বছর ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের এবং এন্টিবায়োটিকের ব্যবহারে নৈরাজ্য চলে আসছে। ওষুধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মাঠ পর্যায়ে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনকারী ও বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি করলেও দৃশ্যমান কিছু চোখে পড়ছে না বলে জানিয়েছেন ওষুধ ব্যবসায়ীরা। 

 

এক ব্যবসায়ী ইত্তেফাককে বলেন, মিটফোর্ড ওষুধের মার্কেটে তার দুটি দোকান ছিল। ২০ বছর সেখানে তিনি ওষুধের পাইকারি ও খুচরা বেচাকেনা করেছেন। তিনি অনেককেই নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি করতে দেখেছেন। কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির কতিপয় নেতাও ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রয়ে ব্যবসায়ীদের প্রভাবিত করেছেন। আর এমন ‘ওষুধ’ নামক পদার্থটির বিক্রেতাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পান তারা। ডায়াবেটিস ওষুধের মধ্যে ইনসুলিন এবং এন্টিবায়োটিকসহ অত্যাবশ্যকীয় সব ওষুধের নকল তৈরি করছে তারা এবং বাজারজাত করে আসছে। আর মিটফোর্ড মার্কেট থেকে এসব ওষুধ সারা দেশে যাচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের ছড়াছড়ি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ ব্যবসায়ী বলেন—নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি করতে সমিতি থেকে তাকে চাপ প্রয়োগ করা হলেও তিনি এ ধরনের ওষুধ বিক্রি থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু একপর্যায়ে এসব বিক্রির জন্য সমিতির প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে না পেরে ২০ বছর আগেই তিনি সেখানকার ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেন। ওষুধের দুটি দোকানই বিক্রি করে দেন। পরে ধানমন্ডি এলাকায় ওষুধের ব্যবসা শুরু করেন। মোবাইল কোর্ট বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে মিটফোর্ড এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ জব্দ ও বিক্রেতাদের জেল জরিমানা করেছেন। কিন্তু এসব ওষুধ বিক্রি বন্ধ হয়নি।

 

বিদেশি ওষুধের নকলই বেশি হচ্ছে। বিদেশি বিভিন্ন নামিদামি প্রতিষ্ঠানের ওষুধ নকল করে বাজারজাত করে আসছে অসৎ ঐ সিন্ডিকেটটি। এদের সঙ্গে ওষুধ প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তাও জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

আশির দশকের শেষের দিকে ভেজাল ও নিম্নমানের প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে ২ সহস্রাধিক শিশু কিডনি ও লিভার বিকল হয়ে মারা যায়। সেই ‘প্যারাসিটামল ট্র্যাজেডি’র পরও নকল, ভেজাল ওষুধের বাজারজাত নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি। বরং রাজধানী থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত এগুলো ছড়িয়ে পড়ছে। এসব ‘ওষুধ’ নামক বিষ সেবন করে নীরবে কত লোকের মৃত্যু হচ্ছে, কে তার খবর রাখে? দৃশ্যমান কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা ছাড়া ভেজাল ও নকল ওষুধ বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মন্তব্য করেছেন।

 

প্রখ্যাত কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ও কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, ভেজাল ও নকল ওষুধ সেবনে হঠাত্ কিংবা দীর্ঘ মেয়াদে কিডনি বিকল হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কিডনি বিকল রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির এটাই অন্যতম কারণ বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া এন্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ওষুধ বিক্রেতার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে অনেক মানুষের জীবন রক্ষা পেতে পারে। শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. শফি আহমেদ মোয়াজও বলেন, আইন প্রয়োগ করে শাস্তি নিশ্চিত করলে ভেজাল ও নকল ওষুধ বিক্রির প্রবণতা কমিয়ে আনা সম্ভব।

 

স্বনামধন্য এক বিশেষজ্ঞ ক্যানসার চিকিৎসক বলেন, ভেজাল ও নকল ওষুধ খেয়ে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন কত লোকের যে মৃত্যু হচ্ছে, সেই তথ্য কারো কাছে নেই কিংবা এ নিয়ে প্রশাসনের কোনো মনিটরিংও নেই। শ্যামলী ২৫০ বেডের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ হাসপাতালের প্রধান উপপরিচালক ডা. আয়েশা বেগম বলেন, ভেজাল, নকল ওষুধ খেয়ে রোগীরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এসব ওষুধ বাজারজাত বন্ধে বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা জরুরি বলে তিনি পরামর্শ দেন। চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এমএন হুদা বলেন, চুলকানি খোস-পাঁচড়া ও দাদ রোগ ব্যাপক হারে বাড়ছে। দুই/তিন ধরনের ওষুধ ব্যবহারেও রোগীরা সুস্থ হচ্ছে না। আমদানিকৃত প্রতিটি ওষুধ এবং কসমেটিক পরীক্ষা করে সেগুলো মানুষের জন্য নিরাপদ কি না, তা নিশ্চিত হয়েই বাজারজাতের অনুমোদন দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

 

একসময় ভেজালবিরোধী অভিযানের জন্য খ্যাত সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট রোকন উদ-দৌলাহ বলেন, নকল ও ভেজাল ওষুধসামগ্রী পরীক্ষা করে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা করা গেলে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

 

ইত্তেফাক/এমএএম

注释