বয়সের প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করেন যেসব সাহাবী

মন্তব্য · 41 ভিউ

শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঠিক বয়স কত—এ ব্যাপারে একটি হাদিসের আলোকে বলা যায়, সাত বছর বয়স থেকে তা হতে পারে। ন

শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঠিক বয়স কত—এ ব্যাপারে একটি হাদিসের আলোকে বলা যায়, সাত বছর বয়স থেকে তা হতে পারে। নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে নামাজের নির্দেশ দাও।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৫)

এতে বোঝা যায়, নামাজ যদিও বালেগ হওয়ার পর ফরজ হবে; কিন্তু নামাজের শিক্ষাদান করতে হবে সাত বছর বয়স থেকেই। কাজেই সাত বছর বয়সই যথারীতি শিক্ষাদানের উপযুক্ত সময়।

এরপর বিলম্ব করা যেমন ঠিক নয়, তেমনি এর আগে চাপাচাপি করাও উচিত নয়। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে পবিত্র কোরআনের তিলাওয়াত শিক্ষা। আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তা সহজ করে দিয়েছেন। শিশুর বয়স যত কমই হোক না কেন, কোরআনের শিক্ষা তার ব্রেনে কোনোরূপ চাপ সৃষ্টি করে না।

তবে হ্যাঁ, বাল্যকালে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় জ্ঞান আহরণ করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। এতে অনেকে হীনমন্যতায় ভোগেন। কেননা জীবনের শেষ দিনগুলো অবধি ইবাদত ও আমল করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। তাই লোক-লজ্জার ভয়ে অনেকের শেখার আগ্রহ হয়ে উঠে না। কিন্তু ইসলামের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দ্বিনি জ্ঞান অর্জনে বয়স বাধা নয়।

মুসলিম মনীষীদের অনেকেই শৈশব-কৈশোরের ধাপ পেরিয়ে ধর্মীয় জ্ঞান আহরণে আত্মনিয়োগ করেছেন। শুধু তাই নয়, দ্বিন-ইসলামকে যথাযথভাবে অনুধাবনের জন্য যে বোধশক্তি ও বিবেক থাকা দরকার—তা অনেক ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়সের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ কারণে আল্লামা সুয়ুতি (রহ.) বলেন, ‘কোনো কোনা আলেমের মতে হাদিস শ্রবণের সূচনা হওয়া উচিত ৩০ বছর থেকে।’ (তাদরিবুর রাবি ১/৪১৪)

পরিণত বয়সে দ্বিন শেখার কিছু ইতিবাচক দিক
শিশু-কিশোর সাধারণত অভিভাবকদের চাপে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করে। ভেতরের প্রেরণা, নিজের ইচ্ছা ও দৃঢ় সংকল্প থাকে অনুপস্থিত। কিন্তু একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি অবস্থা এর চেয়ে ভিন্ন। বয়স্ক ব্যক্তির মনে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের প্রেরণা সৃষ্টি হয় মনের ভেতর থেকে। ফলে বয়স্ক ব্যক্তির অদম্য আগ্রহ ও সুদৃঢ় সংকল্প তাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যায় লক্ষ্যপানে। কয়েকটি উপমা দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে—
ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবিদের অনেকেই ছিলেন বয়সে বড়। বয়স তাঁদের ইলম অণ্বেষণ ও শিক্ষাগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মাদ্রাসার বা ধর্মীয় শিক্ষালয়ের নাম দারুল আরকাম। এই মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন মহানবী (সা.) এবং শিক্ষার্থী ছিলেন সাহাবায়ে কিরাম (রা.), যাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন বয়স্ক। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে পাঠ গ্রহণ করে যেসব সাহাবি সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে সমাসীন হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন বয়স্ক। যেমন—আবু বকর (রা.), ওমর (রা.), আবু জর (রা.), আবু দারদা (রা.) প্রমুখ।

আবু বকর (রা.)-এর দ্বিনি জ্ঞান অর্জন শুরু হয় প্রায় ৪০ বছর বয়সে। উমর (রা.) ৩০ বছর বয়সে ইলমের ময়দানে পা রাখেন। ইমাম বুখারি (রহ.) এ বিষয়ে ‘ইলম’ অধ্যায়ে উমর (রা.)-এর একটি বক্তব্য উল্লেখ করেছেন—
পরিচ্ছেদ : ইলম ও হিকমতের ক্ষেত্রে সমতুল্য হওয়ার আগ্রহ প্রসঙ্গে। আর উমর (রা.) বলেন, ‘তোমরা বয়স বেশি হওয়ার আগেই ইলম শিখে নাও।’
এ কথার ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারি (রহ.) বলেন, ‘অর্থাৎ বয়স বেশি হওয়ার পরও ইলম শিক্ষা করো। কারণ, সাহাবায়ে কেরাম (অধিকাংশ) তো বয়স অধিক হওয়ার পরই দ্বিনি ইলম শিক্ষা করেছেন।’ (সহিহ বুখারি, পৃ. ৩৯)

বেশি বয়সে দ্বিনি জ্ঞান অর্জনের আরো কয়েকটি নজির দেখা যাক—
আল্লামা ইবনে হাজম (রহ.), বয়স হওয়ার পর যারা ইলম শেখা শুরু করেছেন তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধতম ব্যক্তি।
তাঁর ইলমে ফিকহ অন্বেষণের সূচনা হয়েছিল বিশেষ একটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে। ইবনে হাজম নিজেই সে ঘটনা বলেছেন। একদিন তিনি এক জানাজায় শরিক হন। তখন এক মসজিদে প্রবেশ করে বসে পড়েন। এক ব্যক্তি তখন তাকে বলল, ওঠ, আগে তাহিয়্যাতুল মাসজিদ নামাজ পড়ো। তখন তার বয়স ছিল ২৬।  তিনি তখন নামাজে দাঁড়িয়ে যান। জানাজা শেষে ফিরে আসার সময়ও মসজিদে যান। এবার প্রবেশ করা মাত্রই নামাজ শুরু করে দেন। তখন তাকে বলা হল, আরে বস বস; এখন নফল নামায পড়ার সময় নয়। তখন ছিল আসরের পর। এ ঘটনাটি তার মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। এরপর থেকেই তিনি ইলম অর্জন শুরু করেন। তার এ অজ্ঞতাই ইলম অর্জনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। [মুজামুল উদাবা, ইবনে হাজম (রহ.)-এর জীবনী)

বয়স হওয়ার পর যারা ইলম শেখা শুরু করেছেন তাঁদের মধ্যে আরো একজন ব্যক্তি হলেন আবু বকর আল-কাফফাল (রহ.)। তিনি শাফেঈ মাজহাবের অন্যতম ইমাম ছিলেন। তাঁর বয়সের কোঠা ৩০ পেরিয়ে যাওয়ার পর ইলম অন্বষণের তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এক পর্যায়ে ফিকাহ শাস্ত্রে ব্যুত্পত্তি অর্জন করেন। (তাবাকাতুশ শাফিইয়্যা ৫/৫৪)

বয়স হওয়ার পর যারা ইলম শেখা শুরু করেছেন তাঁদের মধ্যে আরো একজন ব্যক্তি হলেন আবু আবদুল্লাহ আসবাগ ইবনুল ফারজ (রহ.)। তিনি মালেকি মাজহাবের বরেণ্য ফকিহ। আল্লামা জাহাবি (রহ.) তাঁর ব্যাপারে বলেন, তিনি পৌঢ় বয়সে ইলম অর্জনে আত্মনিয়োগ করেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা ১০/৬৫৬)

তবে হ্যাঁ, বয়স হয়ে যাওয়ার পর দ্বিন শেখার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতাও আছে। সংসার, উপার্জনের ভয় ছাড়াও বয়স একটু বেশি হয়ে গেলে কিছু আর মনে থাকতে চায় না। কোনো কিছু মুখস্থ করতে হলে অনেক সময় লাগে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। তবে এ বাস্তবতা মেনে নিয়েই বলছি, মানুষ যখন কোনো কাজের হিম্মত করে তার জন্য শতভাগ চেষ্টা ব্যয় করে তখন সে কাজ মহান আল্লাহ তার জন্য সহজ করে দেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে আমি তাদের অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সত্কর্মপরায়ণদের সঙ্গে থাকেন।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত : ৬৯)

মন্তব্য
অনুসন্ধান করুন