আমার তো নিজেকেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী অ্যাথলেট মনে হয়’

Comments · 0 Views

খেলোয়াড় পরিচয়ে তাঁদের চেনেন সবাই। কিন্তু সেই পরিচয়ের বাইরে তাঁদের অন্য জীবনটা কেমন? সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়দ

খেলোয়াড় পরিচয়ে তাঁদের চেনেন সবাই। কিন্তু সেই পরিচয়ের বাইরে তাঁদের অন্য জীবনটা কেমন? সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়দের সঙ্গে এই ঝটপট প্রশ্নোত্তর পর্বে সেটাই জানার চেষ্টা…

আজকের তারকা: শিরিন আক্তার

বাংলাদেশের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে অনন্য এক নাম শিরিন আক্তার। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ১৬ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। অলিম্পিকেও দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। শিকড়ের টান, বিকেএসপিতে প্রথম রাতের শিহরণ, বাবার সাইকেল চালানো—সবকিছু নিয়েই তিনি বললেন অকপটে। শুধু দেশের দ্রুততম মানবী নন, তিনি এক সাহসী নারীর প্রতিচ্ছবিও।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ আলম
প্রশ্ন

এক যুগ ধরে আপনি বাংলাদেশের দ্রুততম মানবী। টানা ১২ বারের পর ২০২২ সালে একবার হেরে আবার টানা চারবার জিতেছেন। কিন্তু সেই যাত্রা সহজ ছিল না। জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী ছিল এবং কীভাবে তা পেরিয়েছেন?

শিরিন আক্তার: আমি অনগ্রসর জায়গা থেকে উঠে এসেছি, যেখানে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। মেয়েরা খেলাধুলা করলে বিয়ে হবে কি না, মায়েদের সেই চিন্তা থাকত। মেয়েরা ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরে বেড়াবে, রাস্তার পাশে মাঠে খেলবে, মানুষ দেখবে...এগুলো পছন্দ করত না গ্রামের মানুষ। আমার মায়েরও আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা ছিল। তার ওপর আমি কালো মেয়ে (হাসি)। কঠিন এই পথ আমি পাড়ি দিয়েছি কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায়, সাহস আর সংকল্প নিয়ে।

প্রশ্ন

আপনার বড় বোনের বিয়েও তো বোধ হয় স্কুলে পড়ার সময়ই হয়ে যায়?

শিরিন: আপু তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। ওইটুকুন বয়সেই তাঁকে যেতে হয় শ্বশুরবাড়ি। গ্রামে তখন স্কুল পেরোনোর আগেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত।

বাংলাদেশের দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার
বাংলাদেশের দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তারশামসুল হক
প্রশ্ন

আপনি ব্যতিক্রম হলেন কীভাবে?

শিরিন: খেলাধুলার প্রতি ছোট থেকেই আগ্রহ, সাভার বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়াটা আমাকে টেনে আনে খেলার জগতে। আমি অ্যাথলেট হয়ে যাই। ফলে আমাকে আর স্কুল পেরোনোর আগেই বিয়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল না।

প্রশ্ন

অ্যাথলেট না হলে কি অনেক আগেই বিয়ে হয়ে যেত?

শিরিন: সম্ভবত। এত দিনে হয়তো সংসার হতো, সন্তান হতো। পরিপূর্ণ একজন গৃহিণী হতাম। গ্রামের একজন মানুষই থেকে যেতাম। গ্রামের ওই পরিবেশেই মানুষ হতাম।

মায়ের সঙ্গে শিরিন
মায়ের সঙ্গে শিরিনফেসবুক
প্রশ্ন

কখন মনে হলো আপনি একদিন মা–বাবার গর্ব হবেন?

শিরিন: আমার বাবা-মা ছেলেসন্তান চেয়েছিলেন। পরিবেশ-পরিস্থিতিতে সেটা তখন ঠিক ছিল। আমি বড় হয়ে ভাবতে শুরু করলাম, ছেলে হলে কীভাবে মা-বাবাকে সাহায্য করত? সেটা আমিই করব এবং করেছি। ছোটবেলা থেকেই রান্নাঘরে মায়ের পাশে বসে তাঁকে সাহায্য করতাম। বড় হয়ে আরও দায়িত্ব নেওয়া শিখেছি।

প্রশ্ন

সাতক্ষীরার সদরের দহাকুলা গ্রামের মেয়ে আপনি। সেখান থেকে বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছিলেন কী ভেবে?

শিরিন: ওরকম সচ্ছল অবস্থায় আমি ছিলাম না। ফলে ভালো খাবার, ভালো একটা ঘর, একটা বিছানা, আর একটা মাঠ থাকবে আমার—এই ভেবে ভর্তি হই; যেখানে ঘরে বৃষ্টির পানি পড়বে না বা একটা সুন্দর ঘর থাকবে।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন

ছোটবেলায় নাকি খুব সাইকেল চালাতেন?

শিরিন: হ্যাঁ, বাবার একটাই সাইকেল ছিল। বড় বোন আমাকে সাইকেল চালানো শিখিয়েছিল। সাইকেলটা খুব মজবুত ছিল, তা নয়। ঘাসটাস আনার অসিলায় ওটা চালাতাম। একবার ছোট একটা বাচ্চাকে সাইড দিতে গিয়ে পড়ে যাই। খেজুরগাছের কাঁটার আঘাত পাই। হাতে ব্যথা পাই।

শিরিন আক্তার
শিরিন আক্তারফেসবুক
প্রশ্ন

ছোটবেলায় ঘরের কাজ বেশি করতেন নাকি খেলাধুলা?

শিরিন: দুপুরবেলা আব্বুর চোখ ফাঁকি দিয়ে মাঠে দৌড়ে চলে যেতাম। আব্বু দুপুরে আমাকে ঘুম পাড়াতেন। কিন্তু তিনি ঘুমিয়ে পড়লে আমি চুপি চুপি মাঠে চলে যেতাম। খেলতাম বলে প্রচণ্ড মারও খেয়েছি।

প্রশ্ন

আপনার বাবা এখন কী করেন?

শিরিন: তিনি কৃষক। এখন খুব একটা সক্রিয় নন, বয়স হয়েছে।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন

আপনার তো কোনো ভাই নেই। বোনদের সঙ্গে কেমন ঝগড়া হতো?

শিরিন: ছোটবেলায় বোনদের প্রচুর মারতাম। দুষ্টামির মারামারি আরকি! তিনজনের সঙ্গে একাই মারামারি করে যেতাম (হা হা)।

অ্যাধলেটিকসের অবসরে শিরিন আক্তার
অ্যাধলেটিকসের অবসরে শিরিন আক্তারশিরিনের ফেসবুক
প্রশ্ন

বোনেরা এখন কী করেন?

শিরিন: বড়জন মনিরা পারভীনের বিয়ে হয়ে গেছে, জানেনই। বোনের ছেলে বিকেএসপিতে আছে টেনিসে, ক্লাস নাইনে পড়ে। ছোট দুই বোন আফরোজা সুলতানা আফরিন আর তাসমীরা পারভীন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষবিদ্যালয়ে স্পোর্টস সায়েন্সে মাস্টার্স করছে। ওরা ভার্সিটির ক্রিকেট দলের সদস্য।

প্রশ্ন

আপনি নিজে এখন কী পড়ছেন?

শিরিন: যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রীড়াবিজ্ঞানে মাস্টার্সে দুটি বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়া বাকি। দেশের বাইরে যাওয়ায় দিতে পারিনি, সামনে দেব।

প্রশ্ন

আপনার জীবন নিয়ে কোনো সিনেমা হলে নাম কী হবে?

শিরিন: গল্পটা দেখার পর বলতে পারব। একটা সিনেমা তৈরির কথা হচ্ছিল। বেশ কিছু স্ক্রিপ্টও লেখা হয়েছিল। কিন্তু সেটা এগোয়নি।

কোনো এক অনুষ্ঠানে শিরিন
কোনো এক অনুষ্ঠানে শিরিনফেসবুক
প্রশ্ন

ছুটির দিনে ঘুম, সিনেমা নাকি আড্ডা—কোনটা পছন্দ?

শিরিন: ঘুমাতে ভালোবাসি। এখন বিশ্রাম ভালো লাগে। প্রিয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলা, ভালোমন্দ শেয়ার করি।

প্রশ্ন

প্রিয় গান?

শিরিন: ‘যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায়’।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন

শিরিন কি নিজেকে সফল মনে করেন?

শিরিন: যত দূর আসতে পেরেছি, আমি খুশি এই ভেবে যে গ্রামে এখন কেউ আমার বাড়িতে এলে এবং তাঁর পেটে সন্তান থাকলে বলেন, তাঁর সন্তান যেন শিরিনের মতো অ্যাথলেট হয়। আসলে খেলাধুলা নিয়ে গ্রামের ভ্রান্তধারণা অনেক বদলেছে। এটা তৃপ্তি দেয়।নিজে যেটা করতে চাও সেটা খেলাধুলা হোক বা জুতা সেলাইয়ের কাজ, মন দিয়ে করো। সেরা হও।

নিজে যেটা করতে চাও সেটা খেলাধুলা হোক বা জুতা সেলাইয়ের কাজ, মন দিয়ে করো। সেরা হও।
শিরিন আক্তার, অ্যাথলেট
জিমে শিরিন আক্তার
জিমে শিরিন আক্তারফেসবুক
প্রশ্ন

আপনি এখন বহু মেয়ের আদর্শ। তাঁদের উদ্দেশে একটি উপদেশ দিলে কী দেবেন?

শিরিন: নিজে যেটা করতে চাও সেটা খেলাধুলা হোক বা জুতা সেলাইয়ের কাজ, মন দিয়ে করো। সেরা হও।

প্রশ্ন

পাহাড়, সমুদ্র না গ্রাম—কোনটা বেশি ভালো লাগে?

শিরিন: সবই। প্রকৃতি ভালো লাগে। আমার পৃথিবী ঘুরে দেখার ইচ্ছা। পৃথিবীটা আল্লাহ অনেক সুন্দর করে সাজিয়েছেন। অনেকগুলো দেশে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। আরও কিছু দেশে যাওয়ার ইচ্ছা আছে।

প্রশ্ন

দৌড় ছাড়া শিরিনের আর কী প্রতিভা আছে?

শিরিন: দৌড়টাই ভালো পারি (হাসি)। আর এর পেছনে রয়েছে সারা বছর করা আমার কঠোর অনুশীলন।

ঘুরতে পছন্দ করেন শিরিন
ঘুরতে পছন্দ করেন শিরিনফেসবুক
প্রশ্ন

এক সপ্তাহের ছুটি পেলে কী করবেন?

শিরিন: স্বপ্নের দেশ সুইজারল্যান্ডে যেতে চাই।

প্রশ্ন

সঙ্গে কাকে নেবেন?

শিরিন: যদি কখনো প্রিয় কেউ থাকে, তাঁকে নেব। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি একাই যেতে চাই।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন

আপনার প্রিয় রং?

শিরিন: সাদা।

কোনো এক জাতীয় অ্যাথলেটিকসে শিরিন
কোনো এক জাতীয় অ্যাথলেটিকসে শিরিনপ্রথম আলো
প্রশ্ন

কেন?

শিরিন: বিকেএসপিতে কলেজ ড্রেসটা পুরোই সাদা। এক দিন তা পরে আয়নার সামনে দাঁড়ানোর পর নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করি। অসাধারণ লাগছিল নিজেকে। পায়ে কালো জুতা, চুলে ঝুঁটি। নিজেকে পরির মতো লাগছিল। সেই থেকে সাদার প্রতি আলাদা ভালোবাসা।

প্রশ্ন

বিকেএসপিতে আপনার প্রথম রাতটা কেমন ছিল?

শিরিন: খুব শিহরিত ছিলাম। সেখানে পা দিয়েই ভাবি, এটা আমার মাঠ, আমার ঘর, আমার খাবারঘর! এই তিনটা দেখে ঘোরে ছিলাম। বিকেএসপির পরিবেশ দেখেও মুগ্ধ হই।

প্রশ্ন

বিকেএসপিতে আপনার সবচেয়ে অপছন্দের খাবার কী ছিল?

শিরিন: করলা ভাজিটা তখন খেতে ইচ্ছা করত না। এখন অবশ্য খুবই পছন্দ।

প্রশ্ন

বিকেএসপির কোন জায়গাটা সবচেয়ে বেশি প্রিয়?

শিরিন: অ্যাথলেটিকস মাঠ। ওখানেই সবচেয়ে বেশি যাওয়া হয়। প্র্যাকটিস না থাকলে বা অফ ডে–তেও গিয়ে বসে থাকি, বাতাস খাই।

শিরিন আক্তার
শিরিন আক্তারফেসবুক
প্রশ্ন

শেষ কবে কান্না করেছেন?

শিরিন: বাড়ি থেকে ঢাকায় ফেরার সময়। প্রতিবারই আব্বু-আম্মু কান্না করেন। তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া আমার জন্য বিষাদময় হয়। আমিও কান্না করি।

প্রশ্ন

টাইম মেশিন পেলে কোন সালে ফিরে যেতে চাইবেন?

শিরিন: ছোটবেলায়। ২০০৭-০৮ সালের দিকে। নিজেকে আরেকটু সুন্দরভাবে গড়ার চেষ্টা করব।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন

আপনার প্রিয় অ্যাথলেট?

শিরিন: শেলি অ্যান ফ্রেজার। অলিম্পিক সোনাজয়ী ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ছিলেন তিনি। জ্যামাইকার এই অ্যাথলেটের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার, কথা হয়েছে। এটা দারুণ স্মৃতি। তাঁর উচ্চতা আর আমার উচ্চতা সমান—৫ ফুট ২ ইঞ্চি।

প্রশ্ন

অ্যাথলেটিকস ছাড়া প্রিয় খেলা কোনটি?

শিরিন: ফুটবল দেখি। ক্রিকেট কম দেখা হয়। বাস্কেটবল ভালো লাগে।

প্রশ্ন

অন্য খেলায় আপনার প্রিয় খেলোয়াড় কে?

শিরিন: সাকিব আল হাসান ভাই। খেলার প্রতি ওনার নিবেদন ভালো লাগে। উনি যখন বিকেএসপির ছাত্র, আমিও তখন বিকএসপিতে।

প্রশ্ন

নিজেকে তিন শব্দে কীভাবে বর্ণনা করবেন—দেশের দ্রুততম মানবী, দোহাকুলার অনন্য শিরিন নাকি অন্য কিছু?

শিরিন: শিরিন আক্তার অলিম্পিয়ান (ফেসবুক আইডিতে এটাই আছে)। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে খেলেছি। তবে কখনো বলি, ১৬ বারের দ্রুততম মানবী। আমাকে অবশ্য আমার নৌবাহিনী–সতীর্থরা ‘আয়রন লেডি’ বলে।

‘আয়রন লেড’ শিরিন
‘আয়রন লেড’ শিরিনশামসুল হক
প্রশ্ন

কখনো প্রেমপত্র লিখেছেন?

শিরিন: (কিছুটা চুপ, হাসি)।

প্রশ্ন

হ্যাঁ বা না বলুন।

শিরিন: হাসি। হু হু...(বোঝা যাচ্ছে লিখেছেন)।

প্রশ্ন

শিরিনের জীবনের ক্রাশ কে?

শিরিন: আমি নিজেই নিজের ক্রাশ (হাসি)। অ্যাথলেট শিরিনকে আমার খুবই পছন্দ।

নিজের সবকিছু আমার ভালো লাগে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী হিসেবে নিজেকে দাবি করি.. হা হা... সুন্দরী অ্যাথলেট...।
শিরিন আক্তার, অ্যাথলেট
প্রশ্ন

কী রকম?

শিরিন: নিজের সবকি

Comments