ব্যায়াম, চুল প্রতিস্থাপন, অনলাইন বৈঠকে সময় কাটাচ্ছেন পলাতক আ. লীগ নেতারা

Yorumlar · 16 Görüntüler

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আশ্রয় নেন ভারতে??

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আশ্রয় নেন ভারতে।

তখন সাবেক মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষ ও মধ্যম সারির নেতারা ভারতসহ বিশ্বের বহু দেশে আশ্রয় নেন। বাংলাদেশে এখন আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং ছাত্রলীগ সংগঠনটি নিষিদ্ধ।

 

হাসিনার মতো আরও যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের মধ্যে বাংলাদেশের সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতও রয়েছেন। গত এক বছরে তিনি নিজের নতুন কিংবা পুরোনো কোনো শখের পেছনে ছোটার সময় পাননি। দলের কাজে তিনি ব্যস্ত। তার মূল লক্ষ্য হলো শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরানো। এটি তিনি করতে চান অধ্যাপক মুহাম্মদের ইউনূসের সরকারকে সরিয়ে। তার দাবি এই সরকার ‘অবৈধ’।

সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী দ্য প্রিন্টকে ফোনে বলেন, হাসিনা চলে যাওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ এক অতল গহ্বরের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমার এখন একটাই লক্ষ্য—বাংলাদেশকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা। আমার কোনো শখ নেই, খেলাধুলার সময় নেই, এমনকি অন্য কোনো বিনোদনেও নিজেকে জড়ানোর সুযোগ নেই।

তার কাছে কাজ মানে হলো বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মসূচির পরিকল্পনা করা এবং নির্বাসনে থাকা আওয়ামী লীগের কর্মী ও শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ রক্ষা করা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য জানান, শুধু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই নন, আরও অনেকে নির্বাসনে আছেন। তার কথায় নাগরিক সমাজের অধিকারকর্মী, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তা ও কূটনীতিকেরাও যোগ দিয়েছেন।

এই নেতার দাবি, ‘মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের প্রতিহিংসামূলক’ অভিযানের কারণে তারা বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন, এই সংখ্যাটা যদি গুনতে যান, তা দুই হাজার ছাড়িয়ে যাবে।

ভারতে যারা আছেন, তারা বেশিরভাগই কলকাতার উপকণ্ঠে পরিকল্পিত উপশহর নিউ টাউনে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রশস্ত রাস্তা, সহজে ভাড়া পাওয়া যায় এমন সাশ্রয়ী অ্যাপার্টমেন্ট, শপিং মল, ফিটনেস সেন্টার এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিকটবর্তী অবস্থান নিউ টাউনকে তাদের জন্য আদর্শ আবাসস্থলে পরিণত করেছে।

বাংলাদেশে ফেলে আসা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এই নির্বাসিতদের দিনযাপন এখন প্রায় রুটিনমাফিক হয়ে গেছে—ফজরের নামাজ আদায়, জিমে অনুশীলন বা ভোরের হাঁটা, সন্ধ্যা নামলেই দেশের ভেতর ও প্রবাসে ছড়িয়ে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে অনলাইন বৈঠক, আর হৃদয়ের গভীরে লালিত একটাই আশা—শিগগিরই ফিরে যাওয়া।

নির্বাসিতদের তালিকায় আছেন বাংলাদেশের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও, যাকে গত অক্টোবরে ওই এলাকায় দেখা যায়।

‘এখানে বিশ্রাম নিতে আসিনি’

নিউটাউনে বসবাসরত আওয়ামী লীগের এক সাবেক সংসদ সদস্য দ্য প্রিন্টকে জানান, তিনি নিয়মিতই আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

তার বক্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে একটি প্রশস্ত অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছেন, যেখানে প্রায়ই দলের সহকর্মী ও স্থানীয় প্রতিবেশীরা আসেন, আর তিনি অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকেন।

বর্তমানে আসাদুজ্জামান খান স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় থাকছেন। প্রতি সপ্তাহে তিনি দলীয় বৈঠকের জন্য দিল্লি যান এবং সেখানে ভারতের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। অন্যদিকে, তার ছেলে শাফি মুদ্দাসির খান (জ্যোতি) গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় গ্রেপ্তার হন।

সাবেক ওই সংসদ সদস্যের মতে, দলের নেতা-কর্মীদের মনোবল ধরে রাখার দায়িত্ব এখন আসাদুজ্জামান খানের কাঁধে। তিনি প্রতিদিন অ্যাপার্টমেন্টে আগত সহকর্মীদের বারবার আশ্বস্ত করেন—আমরা এখানে বিশ্রাম নিতে বা স্থায়ীভাবে থাকতে আসিনি। আমরা বেঁচে থাকার জন্য এসেছি এবং আগামীর লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে এসেছি।

প্রতি সপ্তাহে দিল্লি সফর এবং কলকাতায় নিত্য বৈঠক—এসব নিয়ে আসাদুজ্জামান খান ব্যস্ত সময় কাটালেও অন্য আওয়ামী লীগ নেতারা গত আগস্টের তুলনায় এখন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছেন।

‘গোপন’ দলীয় কার্যালয়?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কক্সবাজারের এক সাবেক সংসদ সদস্যের ভাষায়, তাঁদের জীবন এখন একঘেয়ে ছন্দে বাঁধা পড়ে গেছে।

এই সাবেক সংসদ সদস্য বলেন, আমি ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠি এবং ঘরেই ফজরের নামাজ পড়ি। আওয়ামী লীগের আরেক সংসদ সদস্যের সঙ্গে আমি একটি থ্রিবিএইচকে (তিন শয়নকক্ষ, হলঘর ও রান্নাঘর) অ্যাপার্টমেন্টে থাকি।  

তিনি বলেন, নামাজের পর আমরা দুজনই পাশের একটি ফিটনেস স্টুডিওতে যাই, সেটি বেশ ভালো। আমি ভারোত্তোলন করি আর আমার ফ্ল্যাটমেট পিলাটিসের (একধরনের ব্যায়াম) ক্লাস করেন।

দেড় হাজার বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্টটির মাসিক ভাড়া ৩০ হাজার রুপি। সাবেক ওই সংসদ সদস্যের মতে, ভাড়াটা খুব বেশি নয়। তবে তাদের সামান্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে—রান্নার কাজ কিংবা ঘর পরিষ্কারের দায়িত্বে থাকা লোকজনের হঠাৎ করে বিনা নোটিশে কাজে না আসা।

ওই সাবেক সংসদ সদস্য বলেন, আমার রান্না করার অভ্যাস নেই। আমার ফ্ল্যাটমেটেরও একই অবস্থা। তাই যেসব দিনে আমরা রান্না করতে বাধ্য হই, সেসব দিনে আমি ঢাকায় থাকা আমার স্ত্রীকে ভিডিও কল করি। তিনি বিস্তারিত নির্দেশনা দেন।

তিনি বলেন, এটা আমার জন্য নতুন। যখন আমি বাংলাদেশে বাড়িতে ফিরে যাব, কে জানে আমি হয়তো শেফ হিসেবে নতুন পেশাজীবন শুরু করতে পারব।

দুপুরের খাবারের পর একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার পর সন্ধ্যা কাটে বাংলাদেশ, ভারত ও অন্যান্য দেশে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের সাধারণ সদস্য ও কর্মীদের সঙ্গে অনলাইন বৈঠক করে।

দলের নেতাকর্মীরা তাদের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক খবর আদান–প্রদান করেন, বিশ্লেষণ করেন এবং নিজেদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে পরিকল্পনা সাজান।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, কলকাতায় নাকি ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একটি গোপন দলীয় কার্যালয়’ রয়েছে, যার খবর ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও জানে। তবে কক্সবাজারের সেই সাবেক সংসদ সদস্য এ দাবিকে সরাসরি অস্বীকার করেছেন।

ওই সাবেক সংসদ সদস্য বলেন, হ্যাঁ, নিউটাউনে আমরা একটি জায়গা ভাড়া নিয়েছি, যেখানে আমরা সবাই দেখা করি। কলকাতায় প্রায় ১ হাজার ৩০০ দলীয় নেতা আছেন। আমাদের পক্ষে তো সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বসার ঘরে সবাই মিলে বসা সম্ভব হবে না! কিন্তু এটিকে [দলীয়] কার্যালয় বলা হলে সেটা অতিরিক্ত বাড়িয়ে বলা হবে।

কলকাতার নিউটাউন থেকে বহু দূরে কানাডার অটোয়ার কাছের এক শান্ত পরিবেশে নতুন জীবন শুরু করেছেন বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ হারুন আল রশিদ।

তিনি আওয়ামী লীগের সদস্য নন, তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন প্রকাশ্য সমর্থক এবং ইউনূস প্রশাসনের কড়া সমালোচক হওয়ায় দলটির কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছেন।

২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর হারুন আল রশিদকে দেশে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়। সে সময় তিনি মরক্কোয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু তিনি দেশে ফেরার নির্দেশ এড়িয়ে যান এবং ফেসবুকে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক সমালোচনামূলক পোস্ট দিতে শুরু করেন।

হারুন আল রশিদ দ্য প্রিন্টকে বলেন, আমি আমার পোস্টের শিরোনাম দিয়েছিলাম, -বাংলাদেশের জন্য এবং নিজের জন্য একটি আবেদন। এর প্রতিক্রিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার আমার ও আমার পরিবারের পাসপোর্ট বাতিল করে দেয়।

তিনি জানান, এখন তার সময় কাটে লেখালেখি করে। তিনি আরও বলেন, আমি যতটা চাই, তার চেয়ে কম পড়ি, কিন্তু বাড়ির কোথাও না কোথাও আমি একটি বই খোলা রাখি। সকালের চায়ের সঙ্গে পাঁচটি পৃষ্ঠা আর ঘুমাতে যাওয়ার আগে একটি অধ্যায়।

হারুন আল রশিদ জানান, বর্তমানে নিজের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হচ্ছে। এ কারণে মাঝে মাঝে তিনি কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তবে তিনি সরল জীবনযাপন করছেন এবং এমন কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত নন যা তাকে ঘরের বাইরে দীর্ঘ সময়ের জন্য ব্যস্ত রাখে।

ইউনূসকে ঘিরে ক্ষোভ থাকলেও যখনই রশিদ লেখার টেবিলে বসে টানা একটি পরিপাটি অনুচ্ছেদ লিখতে পারেন, তাঁর দিনটা ভালো কাটে। এমন দিনগুলোতেই গড়ে উঠছে তার প্রথম কল্পকাহিনির খসড়া—বাংলাদেশকে নিয়ে রচিত এক হতাশার উপন্যাস।

এই উপন্যাসের নাম ‘দ্য ম্যাপমেকার্স প্রেয়ার্স’। কাহিনি আবর্তিত হয়েছে কল্পিত চরিত্র ওয়াদুদকে কেন্দ্র করে, যেখানে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম পর্যন্ত ইতিহাসকে উপজীব্য করা হয়েছে।

হারুন আল রশিদের গল্পের নায়ক ওয়াদুদের জগৎটি নিরাশায় কালো। তবে ঢাকা থেকে কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগের এক সাবেক তরুণ সংসদ সদস্য আনন্দের কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছেন।

ওই সাবেক সংসদ সদস্য ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে নিউটাউনের একটি ২বিএইচকে অ্যাপার্টমেন্টে একা থাকছেন, তিনি অবকাশের সুযোগে নিজের মাথায় চুল প্রতিস্থাপন করিয়েছেন।  

ওই তরুণ বলেন, আমি যখন ঢাকা থেকে পালিয়ে আসি, তখন আমার মাথার চুল কমে গিয়েছিল। আমার স্ত্রী আমাকে কয়েক বছর ধরে চুল প্রতিস্থাপন করতে বলছিলেন। কিন্তু প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় আমি আমার নির্বাচনী এলাকা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে ঢাকায় কখনো সময় বের করতে পারিনি।

ওই সাবেক তরুণ সংসদ সদস্য ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দিল্লিতে পৌঁছান। দক্ষিণ দিল্লির একটি কেন্দ্রে চুল প্রতিস্থাপন করে তিনি নিজেকে নতুন চেহারা দিয়েছেন। তিনি বলেন, এমন কঠিন সময়ে মাথাভর্তি নতুন চুল কিছুটা হলেও ভালো লাগার কারণ।

Yorumlar