বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী দম্পতি মাসুম বাসার ও মিলি বাসার। তাঁরা ২০১৯ সালে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে উত্তরার প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটিতে একটি ফ্ল্যাট কেনেন।
ফ্ল্যাটটি যে ভবনে, সেটির নাম ভার্টিকেল-২। মাসুম বাসার ও মিলি বাসারের ফ্ল্যাট আটতলায়। জানা গেছে, এই ভবনে ১৩-১৪ জন অভিনেতা-অভিনেত্রী ফ্ল্যাট কিনেছেন।
মাসুম বাসার ২০২৪ সালে সব টাকা পরিশোধ করে ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রি করেন। কিন্তু এখন পড়েছেন বিপদে। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃক বলছে, ওই বিল্ডিংয়ের উচ্চতা বেশি, যা বিমান চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এই বিল্ডিংয়ের ওপরের দিক থেকে শুরু করে ছাদের বাড়তি স্থাপনা অর্থাৎ সিঁড়িঘর, পানির ট্যাংক, লিফটের মেশিনঘর, তারকাঁটা, বাউন্ডারি ওয়াল, অ্যানটেনা, খুঁটিসহ প্রায় ৩৩ ফুট ভাঙতে হবে।

ভবনটি ভাঙলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আটতলার বাসিন্দা মাসুম বাসার ও মিলি বাসার, নাট্যপরিচালক হিমু আকরাম এবং ভবনমালিক সৌরভ রহমান। এ ছাড়া সাততলার বাসিন্দা অভিনেত্রী নাবিলা ইসলামসহ অন্য ফ্ল্যাটমালিকদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ ভবনের ছয়তলায় ফ্ল্যাট কিনেছেন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী।
ভার্টিকেল-২ নামের ভবনে আরও কয়েকজন অভিনয়শিল্পী ফ্ল্যাট কিনেছেন। তাঁরা হলেন শামীম জামান, নিলয়, শ্যামল মওলা, সামিয়া অথৈ, সাজু খাদেম, আ খ ম হাসান, নাজিয়া হক অর্ষা ও তাঁর স্বামী মোস্তাফিজুর নূর ইমরান এবং আরফান আহমেদ।
তারকারা থাকেন বলে স্থানীয় লোকজন ভবনটিকে ‘তারকা বাড়ি’ হিসেবে চেনে।

গত ২৮ মে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এক চিঠির মাধ্যমে জানায়, প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটির ছয়টি ভবনের উচ্চতা নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি। বাড়তি উচ্চতা বিমান চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছে সিভিল এভিয়েশন। তাই ভবনগুলোর একাংশ ভাঙতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।
‘দুই প্রতিষ্ঠানের (সিভিল এভিয়েশন ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্রিয়াংকা) ভুলের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছি। অভিনয়শিল্পীদের এই অসহায়ত্বের কথা কার কাছে বলব?’
প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ‘ভার্টিকেল-২’ ভবনের মালিক সৌরভ রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভবনটি কত ফুট উচ্চতায় করা যাবে, তা যাচাই করে ২০১৯ সালের ২১ মার্চ চিঠি দেয় সিভিল এভিয়েশন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি ভবন তৈরি করেছেন। এখন সিভিল এভিয়েশন উচ্চতা পুনর্নির্ধারণ করেছে। এতে বিপদে পড়েছেন তিনিসহ ওই ভবনের ফ্ল্যাটমালিকেরা।
সৌরভ রহমান বলেন, তিনি ছাদের ওপর কিছু স্থাপনা করেছেন, যা অনুমোদনহীন। সেটা ভেঙে ফেলবেন। কিন্তু সিভিল এভিয়েশনের ভুলের কারণে আটতলার পুরোটা ভেঙে ফেলতে হলে তাঁকে ক্ষতিপূরণ কে দেবে?’

ছয় ভবনের উচ্চতা বেশি
ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নির্দেশনা অনুযায়ী বিমানবন্দরের রানওয়ের ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ভবন তৈরি করতে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। তারা কত উচ্চতায় ভবন নির্মাণ করা যাবে, তা ঠিক করে দেয়। ‘উচ্চতা নীতি’ লঙ্ঘন করে নির্মিত ভবন ভাঙার কাজ শিগগিরই শুরু করার কথা বলছে সিভিল এভিয়েশন ও রাজউক।

প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটির ছয়টি ভবন পরিদর্শন ও নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৩ নম্বর প্লটে নির্মিত ভবনে সিভিল এভিয়েশন প্রথম চিঠিতে উচ্চতা দিয়েছিল ৮২ ফুট। সে অনুযায়ী ভবন বানানো হয়। তবে বাড়ির মালিকেরা ছাদে অতিরিক্ত স্থাপনা হিসেবে সিঁড়িঘর, পানির ট্যাংক, লিফটের মেশিনঘর, ছাদের নিরাপত্তাপ্রাচীর, অ্যানটেনা ও খুঁটি নির্মাণ করায় উচ্চতা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১০২ ফুটে। পরে সিভিল এভিয়েশন নতুন চিঠিতে উচ্চতা ঠিক করে ৬০ ফুট। সংস্থাটির মতে, বিল্ডিংটিতে প্রায় ৩৩ ফুট অবৈধ স্থাপনা আছে।
‘নথিপত্র দেখেই আমরা ফ্ল্যাট কিনেছি। এখন সিভিল এভিয়েশনের ভুলে ফ্ল্যাট ভেঙে ফেলা হলে আমাকে ক্ষতিপূরণ কে দেবে?’
অন্য পাঁচটি ভবনেও একইভাবে উচ্চতা বেশি রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে একটির অন্যতম মালিক মো. রেজাউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘নকশাবহির্ভূত অতিরিক্ত অংশ ভেঙে ফেলা হবে। তবে মূল ভবন ভাঙলে সিভিল এভিয়েশনের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া না হলে উচ্চ আদালতে যাব।’

বাউনিয়া এলাকার প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটির ছয়টি ভবনে মোট ফ্ল্যাট ১০৬টি। দিয়াবাড়ি এলাকাটি শুটিং স্পট হওয়ায়, শিল্পীরা ভার্টিকেল-২ ভবনে ফ্ল্যাট কিনেছেন। ওই ভবনে প্রথম এসেছিলেন অভিনেতা শামীম জামান। পরে তিনি অন্য অভিনয়শিল্পীদের সেখানে ফ্ল্যাট কেনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ফ্ল্যাট ভাঙার খবর শুনে বিপাকে পড়েছেন তিনি।
‘আমরা অনুমোদনের বাইরে যতটুকু বেশি বানাইছি, সেটুকু ভেঙে ফেলব। কিন্তু সিভিল এভিয়েশনের আগের চেয়ারম্যানের দেওয়া অনুমোদনের বিচার কে করবে? তাদের চিঠির ভিত্তিতেই তো আমরা বিল্ডিং বানাইছি।’
‘ভার্টিকেল-২’ ভবনের আটতলায় ১৪৯০ স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাট কিনেছেন নাট্যপরিচালক হিমু আকরাম। পাঁচ বছর ধরে তিনি সেখানে থাকছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘যেহেতু নাট্যজগতের শিল্পীরা এই ভবনে থাকবেন, তাই কাগজপত্র যাচাই করে টেরেসসহ একটা ফ্ল্যাট কিনেছিলাম। অনেক টাকা খরচ করে এটার ইনটেরিয়র ডেকোরেশন করেছি। আমি অবশ্যই আইন মানব। তবে বিমান ওঠানামা নিরাপদ রাখতে, আমার ফ্ল্যাট ভাঙা হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’

জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই প্রতিষ্ঠানের (সিভিল এভিয়েশন ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্রিয়াংকা) ভুলের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছি। অভিনয়শিল্পীদের এই অসহায়ত্বের কথা কার কাছে বলব?’
অভিনয়শিল্পী মাসুম বাশারও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘নথিপত্র দেখেই আমরা ফ্ল্যাট কিনেছি। এখন সিভিল এভিয়েশনের ভুলে ফ্ল্যাট ভেঙে ফেলা হলে আমাকে ক্ষতিপূরণ কে দেবে?’

রাজউককে চিঠি
প্রিয়াংকা সোসাইটির ছয়টি ভবনের ‘উচ্চতা লঙ্ঘন’ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে গত ২২ জুলাই রাজউকের সভাকক্ষে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, সিভিল এভিয়েশন, প্রিয়াংকা সোসাইটি এবং ফ্ল্যাটের মালিকদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বিমান চলাচল নির্বিঘ্ন করতে, বিল্ডিংয়ের অনুমোদনহীন অংশ ভেঙে ফেলতে করণীয় বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটির চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমরা অনুমোদনের বাইরে যতটুকু বেশি বানাইছি, সেটুকু ভেঙে ফেলব। কিন্তু সিভিল এভিয়েশনের আগের চেয়ারম্যানের দেওয়া অনুমোদনের বিচার কে করবে? তাদের চিঠির ভিত্তিতেই তো আমরা বিল্ডিং বানাইছি।’

সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বলছে, শাহজালাল বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে নিতে গত ২০ জুলাই ক্যাটাগরি-২-এ উন্নীত করা হয়েছে। আগে উড়োজাহাজ অবতরণের সময় পাইলটদের ২৩২ ফুট দূর থেকে রানওয়ে দেখতে হতো। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন মেনে এখন থেকে ১৩২ ফুট দূর থেকে রানওয়ে দেখতে হবে।
‘ভুলটা আসলে সিভিল এভিয়েশন করেছে। তাদের দেওয়া ছাড়পত্র নিয়েই প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটি ওই ভবনগুলো করছে। রাজউকের সঙ্গে মিটিংয়ে সংস্থাটি ভুল স্বীকারও করছে। সুতরাং ক্ষতিগ্রস্তরা তো ক্ষতিপূরণ চাইবেই। আমরা চেষ্টা করছি, তাদের যেন কিছুটা হলেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়।’
সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের সদস্য (এয়ার ট্র্যাফিক ম্যানেজমেন্ট—এটিএম) গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. নূর-ই-আলম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তাঁদের প্রথম চিঠির কারণে প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটির ছয়টি ভবনের উচ্চতায় ‘গরমিল’ হয়েছে বলে ওঠা অভিযোগ সত্য নয়। তিনি জানান, ওই এলাকার ৮৭টি ভবন তৈরিতে ‘উচ্চতা নীতি’ মানা হয়নি।

তিনি বলেন, প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটি ভবন তৈরির নকশায় ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের (কো-অর্ডিনেট) যে তথ্য দিয়েছিল, তার ওপর ভিত্তি করে সিভিল এভিয়েশন ভবন তৈরির উচ্চতা ঠিক করে দিয়েছিল। পরে জরিপ অধিদপ্তরের জরিপে ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক নির্ণয়ে ত্রুটি ধরা পড়ে। ফলে আবারও উচ্চতা ঠিক করে নতুন চিঠি দেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।

‘ভুল সিভিল এভিয়েশনের’
১৯৮০ সালে কুর্মিটোলায় প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ১৯৮৩ সালে এটির নামকরণ হয় জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। পরে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার নাম বদলে রাখে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এটি যখন নির্মাণ করা হয়, তখন চারপাশে ছিল বাউনিয়া বিল। ধীরে ধীরে আশপাশে বসতি গড়ে ওঠে, তৈরি হতে থাকে বড় বড় ভবন। সিভিল এভিয়েশনের ‘উচ্চতা নীতি’ লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণ করেছেন অনেকে। তা কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না, বরং বাড়ছে।
গত ২২ জুলাই উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে ৩৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এরপর ব্যাপক সমালোচনার পর বিমানবন্দরের আশপাশে ‘প্রতিবন্ধকতার সীমাবদ্ধকারী’ বা ‘অবসট্যাকল লিমিটেশন সারফেস (ওএলএস)’ ভবন চিহ্নিতের কাজ শুরু করেছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ।

অভিয়নশিল্পী ও অন্যদের ফ্ল্যাটের বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভুলটা আসলে সিভিল এভিয়েশন করেছে। তাদের দেওয়া ছাড়পত্র নিয়েই প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটি ওই ভবনগুলো করছে। রাজউকের সঙ্গে মিটিংয়ে সংস্থাটি ভুল স্বীকারও করছে। সুতরাং ক্ষতিগ্রস্তরা তো ক্ষতিপূরণ চাইবেই। আমরা চেষ্টা করছি, তাদের যেন কিছুটা হলেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়।’
রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিষয়টির সমাধানে আন্তমন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই এ নিয়ে মিটিং করব। তবে প্রিয়াংকা রানওয়ে সোসাইটি ‘উচ্চতা আইন’ লঙ্ঘন করে বিল্ডিংয়ের ওপরে যতটুকু বেশি বানিয়েছে, তা অবশ্যই ভাঙতে হবে।’