মন্ত্রী-এমপিদের ‘আবদার’ মিটিয়ে লোকসানের বোঝা বইছে রেল

Mga komento · 41 Mga view

আওয়ামী লীগ সরকার ৬৬টি নতুন আন্তঃনগর ট্রেন চালু করে
মেইল, এক্সপ্রেস, কমিউটার ও লোকাল ট্রেন চালু করে ৯২টি
জনপ

আওয়ামী লীগ সরকার ৬৬টি নতুন আন্তঃনগর ট্রেন চালু করে
মেইল, এক্সপ্রেস, কমিউটার ও লোকাল ট্রেন চালু করে ৯২টি
জনপ্রিয় ৯৮টি মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেনের চলাচল বন্ধ

মন্ত্রীরা চেয়েছেন, এমপিরা অনুরোধ করেছেন— এভাবেই গত দেড় দশকে বাংলাদেশ রেলওয়েতে চালু হয়েছে ১৫৮টি নতুন আন্তঃনগর, মেইল, কমিউটার ও এক্সপ্রেস ট্রেন। যদিও যাত্রী সংকটে এখন অধিকাংশ ট্রেনই চলছে ব্যাপক লোকসানে। আর এই লোকসান প্রতি বছর গড়াচ্ছে আড়াই হাজার কোটি টাকায়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নতুনভাবে চালু হয়েছে ৬৬টি আন্তঃনগর এবং ৯২টি লোকাল, এক্সপ্রেস ও কমিউটার ট্রেন। একই সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে প্রায় ৯৮টি জনপ্রিয় মেইল ও কমিউটার ট্রেন।

রেলওয়ের অভ্যন্তরীণ তথ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ নতুন ট্রেন চালুর পেছনে ছিল স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশ, যা অনেক সময় সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির আওতায় বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু এসব উদ্যোগের আগে না করা হয় যাত্রী চাহিদা বিশ্লেষণ, না হয় অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাই। ফলে এখন অধিকাংশ ট্রেন চলছে রেলের অর্থনীতি তলানিতে ঠেলে দিয়ে।

বিজয় এক্সপ্রেস: চলাচল কম, খরচ বেশি

২০১৪ সালে চালু হওয়া বিজয় এক্সপ্রেস প্রথমে ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম রুটে চললেও ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা স্থান পরিবর্তন করে জামালপুর করা হয়। যাত্রাপথ দীর্ঘ হওয়ায় কমতে থাকে যাত্রী, বেড়ে যায় অপচয়। এখন ট্রেনটির মাসিক আয় খরচের তুলনায় অনেক কম। আর এই পরিবর্তনের পেছনে ছিল ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের রাজনৈতিক ‘আবদার’।

রেল কর্মকর্তারা বলছেন, যাত্রাপথ পরিবর্তনের আগে কোনো যাত্রী সমীক্ষা বা লাভ-লোকসান বিশ্লেষণ হয়নি। শুধু বিজয় এক্সপ্রেস নয়, এমন অন্তত পাঁচটি আন্তঃনগর ট্রেন চলছে খুব কম যাত্রী নিয়ে—যা মাসে কয়েক কোটি টাকার লোকসান তৈরি করছে।

‘নিজ জেলা প্রীতি’তে ট্রেন, স্টেশন ও নামকরণ

রেলমন্ত্রী থাকার সময় নুরুল ইসলাম সুজন নিজের জেলা পঞ্চগড়কে ঘিরেই গন্তব্য বাড়িয়ে নেন অধিকাংশ আন্তঃনগর ট্রেনের। এমনকি মন্ত্রীর ভাইয়ের নামে একটি স্টেশনের নামকরণ ও নতুন ট্রেন চালুর মতো উদাহরণও তৈরি হয়।

প্রয়াত মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের অনুরোধে চালু হয় সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস। কিন্তু সিরাজগঞ্জে রাতে ট্রেন রাখার জায়গা না থাকায় ট্রেনটি ঈশ্বরদীতে রাখতে হয়, বাড়তি খরচ ও সময়সাধ্য ব্যবস্থাপনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় রেলওয়ে।

লোকসানী প্রকল্পের উদাহরণ: ঢালারচর এক্সপ্রেস

২০১৮ সালে নির্মিত ঢালারচর রেলপথে ১,৭১৫ কোটি টাকা ব্যয় হলেও সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। দুই বছর কোনো ট্রেন চলেনি। পরে ২০২০ সালে ঢালারচর এক্সপ্রেস চালু করা হলেও মাসে আয় হয় মাত্র ৩৬ লাখ টাকা।

এই ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী থাকলেও বেশির ভাগই স্বল্প দূরত্বের যাত্রী হওয়ায় আয়ে তেমন সাড়া মেলে না। রেলের ভাষায়, এটি একটি বড় ‘অপচয় প্রকল্প’।

এক সময় জনপ্রিয়, এখন অব্যবহৃত: উপকূল এক্সপ্রেস

নোয়াখালী রুটের একমাত্র আন্তঃনগর ট্রেন ‘উপকূল এক্সপ্রেস’-এ একসময় ১৯০% পর্যন্ত যাত্রী চলাচল করত। এখন আসন পূর্ণ হয় না। মূল কারণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হওয়ায় যাত্রীরা সময় বাঁচাতে সড়কে ঝুঁকছেন।

২০২৩ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘সুবর্ণচর এক্সপ্রেস’ নামক নতুন ট্রেন চালুর ঘোষণা দেন। কিন্তু কোচ সংকটের কারণে ট্রেনটি চালু হয়নি। পরে অন্তর্বর্তী সরকার কক্সবাজার রুটে নতুন ট্রেন চালু করে।

উত্তরাঞ্চলে চাহিদা বেশি, তবু সীমাবদ্ধতা

উত্তরবঙ্গের পথে চলাচলকারী ট্রেনগুলোতে যাত্রী চাহিদা অনেক বেশি। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, লালমনিরহাট এক্সপ্রেস, বরেন্দ্র এক্সপ্রেস এবং একতা এক্সপ্রেস গড়ে ১১০-১২৪ শতাংশ যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। তবে বিকল্প রেক না থাকায় এগুলোর সময়সূচি ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

রুট রেশনালাইজেশনে ধীর গতি

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রুট রেশনালাইজেশনের কাজ শুরু করেছে। গঠিত হয়েছে অতিরিক্ত সচিব রূপম আনোয়ারের নেতৃত্বে কমিটি। তবে ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও সুপারিশ চূড়ান্ত হয়নি।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, অলাভজনক ও অপ্রয়োজনীয় ট্রেন বন্ধে ধাপে ধাপে কাজ হচ্ছে। তবে স্থানীয় চাপের কারণে সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক বলেন, রেলওয়ে যখন উন্নয়ন প্রকল্প নেয়, তখন দেখানো হয় বিপুল লাভ হবে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা মন্ত্রী হয়ে প্রকাশ্যে বলেন, রেল লাভ করার জন্য চলে না। এগুলো অপেশাদারি কথা। এ জন্যই রেল এক টাকা আয় করতে আড়াই টাকা ব্যয় করে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। 

তিনি আরও বলেন, কোন পথে কত যাত্রীচাহিদা, লাভ-লোকসান বের করা কঠিন কোনো কাজ নয়। সমীক্ষা ছাড়া নতুন ট্রেন চালু কিংবা নতুন স্টেশনে ট্রেন থামানো উচিত নয়।

Mga komento