জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধের চাপ নির্বাচন পেছানোর কৌশল

Comments · 26 Views

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবির আলোচনা ঝড় তুলেছে। এই দাবিকে কেন্দ্র করে ব??

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবির আলোচনা ঝড় তুলেছে। এই দাবিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান।

একদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণঅধিকার পরিষদের মতো দলগুলো জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে সোচ্চার, অন্যদিকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সরাসরি নিষিদ্ধ না চেয়ে বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলছে।

 

এই দাবির নেপথ্যে কি কেবল রাজনৈতিক আদর্শের সংঘাত, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গভীর কোনো কৌশলগত হিসাব-নিকাশ? রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের এই চাপ কেবল একটি দলের অস্তিত্বের প্রশ্ন নয়, বরং এটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সমীকরণের একটি অংশ, যা আগামী নির্বাচনের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবিটি হঠাৎ করে সামনে আসেনি। গত ২৯ আগস্ট জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গণঅধিকার পরিষদের একটি বিক্ষোভ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের সংঘাত হয়। এ ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলায় গণঅধিকার পরিষদের প্রধান নুরুল হক নুরের আহত হওয়ার ঘটনা এই দাবিকে আরও জোরালো করেছে। এই ঘটনা শুধু একটি সংঘাত হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এটি জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোকে আরও বেশি জনসমক্ষে নিয়ে আসে এবং তাদের রাজনৈতিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।

জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে ‘ফ্যাসিবাদ’ বা ‘স্বৈরাচারের সহযোগী’ হওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ১৯৮২ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ক্ষমতা দখল এবং পরবর্তীতে সামরিক শাসনের অধীনে জাতীয় পার্টি গঠন ও ক্ষমতা ধরে রাখার ইতিহাস বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য একটি কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। এরশাদের পতনের পরও জাতীয় পার্টি বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে বা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বজায় রেখেছে।

বিশেষ করে, ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট করে এবং পরবর্তীতে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনগুলোয় অংশগ্রহণ করে জাতীয় পার্টি সমালোচিত হয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবিতে এই অভিযোগ জোরালোভাবে উপস্থিত হয়েছে যে তারা ওই নির্বাচনগুলোয় আওয়ামী লীগের ‘অবৈধ ক্ষমতা’ ধরে রাখতে সহায়তা করেছে এবং এর মাধ্যমে তারা ফ্যাসিবাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটই জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে ওঠা ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ তকমাটিকে শক্তিশালী করেছে এবং তাদের নিষিদ্ধ করার দাবির একটি নৈতিক ভিত্তি তৈরি করেছে।

তাদের মতে, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চলছে জাতীয় পার্টির মাধ্যমে এবং ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এই দলটি কাজ করে যাচ্ছে। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই দাবির পেছনে একটি বড় রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ রয়েছে। তারা বলছেন, যদি জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ না নিতে পারে, তাহলে জামায়াতে ইসলামী বা এনসিপির মতো দলগুলোর জন্য আসন্ন নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। যা আগামী নির্বাচনকে ঘিরে এই দলগুলোর অন্যতম কৌশল হিসেবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে ৩১ আগস্ট অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে। ওই বৈঠকে তিন দলের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে জুলাই সনদ, সংসদ নির্বাচন, নুরুল হক নুরের ওপর হামলা, জাতীয় পার্টি (জাপা) নিষিদ্ধকরণসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জামায়াত ও এনসিপি জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছে, তবে বিএনপি জানিয়েছে তারা কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়।

জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের এই দাবিকে নিছক আদর্শিক বিরোধ হিসেবে দেখা হলে ভুল হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, এর পেছনে সুদূরপ্রসারী কৌশলগত হিসাব-নিকাশ এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন আনার আকাঙ্ক্ষা কাজ করছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব এজেন্ডা এবং নির্বাচনী লক্ষ্য থাকে, যা এই দাবির মাধ্যমে পূরণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সরাসরি জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে। তাদের যুক্তি অনুযায়ী, জাতীয় পার্টি ‘আওয়ামী ফ্যাসিস্টের দোসর’ এবং অবৈধ নির্বাচনের বৈধতা দিয়েছে। এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের এই দাবির পেছনে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ বা ভোটের হিসাব নেই, বরং তারা একটি নতুন জোট গঠনের চেষ্টা করছেন, যা জুলাই সনদ, বিচার এবং সাংবিধানিক সংস্কারের ওপর কাজ করবে।

একই কথা বলছেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি মনে করেন, জাতীয় পার্টির কোনো অধিকার নেই বাংলাদেশে রাজনীতি করার। তারা ফ্যাসিবাদকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে গেছে। বাংলাদেশে সংস্কার হবে, নির্বাচন হবে ও নতুন সংবিধান হবে। জনগণের কাছে এটাই এনসিপির প্রতিশ্রুতি বলে তিনি জানান।  

গত ৩১ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে যমুনায় বৈঠক শেষে জামায়াতের নায়েবে আমির সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের গণমাধ্যমকে বলেন, আওয়ামী লীগের মতো জাতীয় পার্টিকেও নিষিদ্ধ করার পক্ষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম যেভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনিভাবে জাতীয় পার্টিকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে।

Comments