রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো মূলধন সংকটে থাকলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উৎসব বা উৎসাহ বোনাসের বিলাসিতা থামছে না। ক্ষেত্র বিশেষে বেতনের আড়াইগুণ থেকে ছয়গুণ পর্যন্ত বোনাস নিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। তাদের এ বিলাসী উৎসাহ বোনাসের লাগাম টানতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার।
Advertisement
সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকের বোনাস বিলাসিতার লাগাম টানতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন এফআইডির সচিবসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সেখানে উঠে আসে ইতঃপূর্বে ব্যাংকগুলো থেকে বছরে সর্বোচ্চ ৬টি বোনাস নেওয়ার ঘটনাও।
কোনো কোনো ব্যাংক সর্বনিম্ন বেতনের আড়াইগুণ পর্যন্ত বোনাস নিয়েছে। উৎসব বোনাসের নামে এ বিলাসিতা জনগণের অর্থের ক্ষতি-তা উঠে আসে বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) রিপোর্টেও।
জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) সচিব নাজমা মোবারেক যুগান্তরকে জানান, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ধারিত উৎসব বোনাসের বাইরে আরও একাধিক ইনসেনটিভ বোনাস নিচ্ছে। সেটি এখন যৌক্তিক পর্যায়ে আনা হচ্ছে। ব্যাংকগুলো তাদের পারফরম্যান্স ভিত্তিতে ইনসেনটিভ বোনাস নিতে পারবে। এটি একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনা হচ্ছে।
বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) কার্যালয় বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অতিমাত্রায় বোনাস গ্রহণের ওপর আপত্তি দিয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের কুমিল্লা ও এর নিয়ন্ত্রণাধীন কান্দিরপাড় করপোরেট, বিভাগীয় কার্যালয়, চৌদ্দগ্রাম, পায়েরখোলা, ভাউকশার, গৌরীপুর বাজার, তিতাস বাতাকান্দি, জাফরগঞ্জ, দেবিদ্বার নিউমার্কেট, মুরাদনগর বাইরা, হোমনা রামকৃষ্ণপুর, কসবা বায়েক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া করপোরেট শাখার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বেতনের তিন-চারগুণ হারে ইনসেনটিভ বোনাস নিয়েছেন।
এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ছাড়াই মূল বেতনের আড়াইগুণ হারে উৎসব বোনাস দেওয়া হয় সাধারণ বিমা করপোরেশনের প্রধান এবং আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৩ কোটি টাকা। অথচ এ প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা আলোকে পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদনক্রমে সমতা ভিত্তি হারে উৎসাহ বোনাস দেওয়ার কথা। এছাড়া সোনালী ব্যাংকের সিলেটের ৫টি শাখা, কুমিল্লার ২৩টি শাখা, বরিশালের ১৪টি শাখাসহ প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তিন থেকে চারগুণ ইনসেনটিভ উৎসাহ বোনাস নিয়েছেন।
প্রণোদনার আরও তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ইনসেনটিভ বোনাসের অনুমোদন ছাড়াই অগ্রিম ৪ কোটি টাকা ইনসেনটিভ বোনাস দেয়। একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত আরও কিছু ব্যাংক থেকে এ ধরনের বোনাস নেওয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, এতদিন এ সংক্রান্ত নীতিমালা থাকলেও তা লঙ্ঘন করে আসছিল বড় কয়েকটি ব্যাংক। যেমন তিনটি উৎসাহ বোনাসের বেশি পাওয়ার সুযোগ না থাকলেও ২০২৩ সালে পাঁচটি উৎসাহ বোনাস দেয় সোনালী ব্যাংক। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ২৭ মার্চ সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) চিঠি দিয়ে দুটি বোনাসের অর্থ ব্যাংকের কর্মচারীদের কাছ থেকে ফেরত আনার নির্দেশ দেয়। তবে এ টাকা ফেরত দেয়নি কেউই।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এফআইডির অতিরিক্ত সচিব মো. আহসান কবীর যুগান্তরকে জানান, ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাবের কারণে ইচ্ছেমতো বোনাস নিয়েছেন কর্মীরা। বছরে দুটি উৎসব বোনাসের বাইরেও ইনসেনটিভ উৎসব বোনাস নামে সর্বোচ্চ ৬টি বোনাস নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। এখন সেটি যৌক্তিকীকরণ করা হচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রণোদনা হিসাবে বোনাস নিতে হলে এর যৌক্তিক পারফরম্যান্স থাকতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায় করতে পারলেও ধরা হবে একটি যৌক্তিকতা আছে। ব্যাংকের তারল্য বাড়াতে উদ্যোগ নিয়ে বোনাস নিলে সেটিরও যৌক্তিকতা থাকবে। প্রণোদনা বোনাস নিতে হলে খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণের টাকা আদায় ও ব্যাংকের তারল্য বাড়ানোর মতো দক্ষতা দেখাতে হবে ব্যাংকগুলোকে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক উৎসাহ বোনাস দেওয়া হবে পাঁচটি উপাদান বা কর্মসম্পাদন পরিমাপকের ভিত্তিতে। এগুলো হচ্ছে— চলতি মূলধনের ওপর নিট মুনাফার হার, আমানতের পরিমাণ বৃদ্ধির হার, ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ বৃদ্ধির হার, খেলাপি ঋণ আদায়ের হার এবং অবলোপন করা ঋণ আদায়ের হার।
নির্দেশিকার খসড়ায় বলা হয়েছে, ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা থেকে ঋণ ও অগ্রিমের ওপর প্রভিশন, বিনিয়োগের মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধির প্রভিশন এবং অন্যান্য সম্পদ হ্রাস-বৃদ্ধির প্রভিশন সমন্বয় করতে হবে। অর্থাৎ নিট মুনাফার হিসাব করতে হবে। এছাড়া সবচেয়ে বেশি নম্বর থাকছে চলতি মূলধনের ওপর নিট মুনাফার হারে, যা ৫০ এর বেশি। বোনাস দেওয়া হবে নম্বরের ভিত্তিতে। নম্বর প্রাপ্তিতে যারা বেশি ভালো করবে তারা তিনটি বোনাস পাবে। নম্বর কম হলে বোনাসের সংখ্যাও কম হবে। তবে যদি খুব কম হয় তাহলে বোনাস দেওয়া যাবে না। একটি বোনাস বলতে এক মাসের মূল বেতনের সমান অর্থ।