আল-মা’আরি (৯৭৩-১০৫৭), পুরো নাম আবু ল’আলা আহমেদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-মা’আরি। উত্তর আলিপ্পর মা’য়ারায় তাঁর জন্ম। তৎকালে আরবের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন তিনি। জন্মের মাত্র চার বছর বয়সে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে চিরদিনের জন্য দৃষ্টিশক্তি হারান। পরিণত বয়সে তিনি আলিপ্প, অ্যান্টিওকসহ সিরিয়ার অন্যান্য শহর ভ্রমণ করতে সক্ষম হন। এ সময় তিনি সেখানে সংরক্ষিত যাবতীয় হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি মুখস্থ করেন। সেই সময়ে কবিতার কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত বাগদাদ শহরে আল-মা’আরি টানা দেড় বছর অবস্থান করেন। তারপর নিজ শহরে ফিরে এসে ‘লুজুমিয়্যাত’ (দার্শনিক ও নৈতিক কবিতার সংকলন) রচনা করেন। এই বিশাল সংগ্রহ এর নিয়মবিরুদ্ধ গঠন এবং এতে প্রকাশিত মতামতের জন্য সনাতন ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক পর্যায়ে পৌঁছায়। যদিও সেই সময় তাঁর কাব্যময় বক্তৃতা শোনার আকর্ষণে হাজারো শ্রোতা মা’য়ারায় এসে একত্র হতেন।
মা’আরি লিখেছেন, ‘ধীশক্তিসম্পন্ন লোকেরা আমাকে বৈরাগী বলে অভিহিত করেন, কিন্তু তাঁদের এই চিন্তাভাবনা আসলে ভুল। আমি আমার কামনা–বাসনাকে নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। আমি জাগতিক সুখ থেকে পরিত্যক্ত হয়েছি। কেননা সেগুলোর শ্রেষ্ঠতমটিই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।’ অন্য আরও একটি মন্তব্যে তাঁর মানবসঙ্গবিদ্বেষী মনোভাবও প্রকাশ পায়, ‘আমার জ্ঞানের দ্বারা তৈরি সত্তা ধুলায় পরিণত হওয়ার পর থেকে মানুষের সঙ্গে পরিচিতি অনুসারে আমি তাদের সঙ্গ পরিহার করে চলছি।’
‘লুজুমিয়্যাত’–এর ধ্যানে এমন আবেগ রয়েছে, যা গতানুগতিক কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটায়নি। বরং তাতে স্বকীয় এক বিশ্বাসেরই আরোপ ঘটেছে। আর এভাবেই তিনি করেছেন নিয়মের ব্যত্যয়। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি আমার ছত্রসমূহে কল্পনা, প্রেম, স্বপ্নের ঘটনা, যুদ্ধের দৃশ্য বা মদের আড্ডার মতো গল্পের বর্ণনা দিইনি। আমার উদ্দেশ্য সত্যকে তুলে ধরা। আজকাল আর কবিতায় সত্যকে তুলে ধরা হয় না। তার বদলে এতে মিথ্যার মাধ্যমে উৎকৃষ্টতাকে আরোপ করা হয়। আমি তাই আমার পাঠকদের সামনে নৈতিকতার কবিতা নিয়ে হাজির হয়েছি।’
সব ধর্মের প্রতি আল-মা’আরির এই সন্দিগ্ধতা জেনোফেনিস, ক্যারাভেকা ও লুক্রিশাসের সঙ্গে তুলনীয়। অজ্ঞানতা বিদূরিত হওয়ার আগপর্যন্ত পশ্চিমে এমন চিন্তার সন্ধান মেলেনি। সমানভাবে তিনি সেমিটিক ধর্মের প্রতি বিরাগভাজন ছিলেন। তাঁর মতে, নির্দিষ্ট ধর্মের সাধুরা অন্ধভাবে জন্মানুসারে তাঁদের বিশ্বাস আঁকড়ে আছেন। তাঁদের জন্ম অন্য কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর গণ্ডির ভেতরে হলে তাঁরা তখন সেই ধর্মেরই অনুসারী হতেন। তিনি এমন এক যুক্তিবাদী ছিলেন, যিনি সব ধরনের সনাতনতা ও প্রকাশভঙ্গির ওপর যুক্তির ঠাঁই দিতেন। ক্যারাভেকার মতো তিনিও ধর্মকে পুরোহিতজন আর ধর্মের স্থপতিদের আয় ও ক্ষমতার উৎসের এক মানবীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতেন। তিনি মনে করতেন, এই পুরোহিত ও ধর্মের স্থপতিরা জাল নথিতে স্বর্গের প্রেরণা আরোপ করে জাগতিক সুবিধা লাভে ব্যস্ত।