গাজীপুরে মাসে শতকোটি টাকার মাদক কারবার

Kommentarer · 2 Visninger

রাজধানী ঢাকার কাছের শিল্পনগরী গাজীপুরে মাদকের কারবার জমজমাট। জেলার দুই শতাধিক স্থানে রয়েছে মাদকের হাট। সেখ??

* মাদকসম্রাজ্ঞীরা কোটিপতি *
* মাদকাসক্তরা জড়াচ্ছে অপরাধে, অভিভাবক অতিষ্ঠ *
* কারবারি স্ত্রী স্বজনদের কিনে দিয়েছেন ট্রাক, প্রাইভেট কার, বাড়ি, ফ্ল্যাট *

রাজধানী ঢাকার কাছের শিল্পনগরী গাজীপুরে মাদকের কারবার জমজমাট। জেলার দুই শতাধিক স্থানে রয়েছে মাদকের হাট। সেখানে পাইকারি কারবারিই আছেন পাঁচ শতাধিক। প্রভাবশালীদের ছায়াতলে মাদক বাণিজ্যের টাকায় তারা গড়ছেন বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদ।

বিভিন্ন হাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে মাদকসম্রাজ্ঞীরা। তারা মাদকের লাভের টাকায় স্বামীকে কিনে দিয়েছেন প্রাইভেট কার, ট্রাক, অটোরিকশা। কিনেছে বাড়ি-ফ্ল্যাটসহ বিপুল সম্পদ। তবে অভিযানে মাঝেমধ্যে ছোট কারবারিরা গ্রেপ্তার হলেও বড় ব্যবসায়ী ও মূল হোতারা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

অনেক সময় ছোট হোতাদের গ্রেপ্তার করা হলেও নানা ফাঁকফোকরে জামিনে বের হয়ে আবার একই কারবারে যুক্ত হয়েছে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। 

জেলায় মাদকের কারবার বেড়ে যাওয়ায় মাদকাসক্তও বাড়ছে। ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকে আসক্ত সন্তানের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ অভিভাবকরা নিরুপায় হয়ে পড়েছেন।

অবস্থা এমন যে আসক্তরা মাদকের টাকা জোগাড়ের জন্য নিজের মা-বাবাকেও মারধর করছে। মাদক কেনার অর্থ জোগাড়ে ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে তারা। ছেলের মারধরে অতিষ্ঠ জেলার শ্রীপুরের নানাইয়া গ্রামের এক বাবা গত ২৯ এপ্রিল ঘুমন্ত অবস্থায় মাদকাসক্ত ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করেছেন। তারপর থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গাজীপুরে মাদক কারবারের রাজধানী হচ্ছে টঙ্গী।

টঙ্গীর বিভিন্ন বস্তি ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রধান মাদকের হাট। এর মধ্যে রয়েছে এরশাদনগর বস্তি, মাজার বস্তি, ব্যাংকের মাঠ বস্তি, কেরানীর টেক বস্তি। এরই মধ্যে যৌথ বাহিনী দফায় দফায় অভিযান চালিয়ে শতাধিক মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করেছে। তার পরও সেখানে বন্ধ হয়নি কারবার। টঙ্গীতে অধিকাংশ মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন নারী কারবারিরা। টঙ্গীর আলোচিত মাদকসম্রাজ্ঞীদের মধ্যে রয়েছেন ব্যাংক মাঠ বস্তির মোমেলা বেগম, ময়না বেগম ও আফরিনা বেগম। স্থানীয় সূত্র জানায়, তাদের সবাই কোটিপতি। এঁদের মধ্যে মোমেলা বেগম মাদক বিক্রির অর্থে টঙ্গীতে কিনেছেন তিনটি বাড়ি। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের মরকুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন কুদ্দুস খলিফা রোডে ‘জাহিদ হাসান ভিলা’ নামে বহুতল বাড়ি রয়েছে তার। একই ওয়ার্ডের সিলমুন পূর্বপাড়া যুগীবাড়ি সড়কে মাতৃকোল সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির কর্মকর্তা স্বপন মাস্টারের কাছ থেকে অর্ধকোটি টাকায় কেনেন আরও একটি বাড়ি। 

পুবাইলের করমতলা পূর্বপাড়া আবাসিক এলাকায় পৌনে চার কাঠা জমিতে আরও একটি আধাপাকা বাড়ি রয়েছে তার। এ ছাড়া ব্যাংক মাঠ বস্তিতে রয়েছে একাধিক আধাপাকা ঘর। জানা গেছে, মোমেলা তার স্বামী জাহাঙ্গীর আলমকে কিনে দিয়েছে চারটি মিনি ট্রাক ও অটোরিকশা। 

মোমেলা মেয়ের জামাই পুলিশের কথিত সোর্স মো. হৃদয়কে কিনে দিয়েছে ২০ লাখ টাকা দামের প্রাইভেট কার। এ ছাড়া টঙ্গী ও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় মোমেলা মাদক কারবারের টাকায় নামে-বেনামে সম্পদ কিনেছে। 

পুলিশ জানায়, ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোমেলার বিরুদ্ধে টঙ্গী পূর্ব থানাসহ বিভিন্ন থানায় ১৭টি মাদক মামলা দায়ের করা হয়। এ ছাড়া মাদক কারবারি ময়না বেগমের হয়ে ব্যবসা করে তার ভাই একাধিক মাদক মামলার আসামি শফিকুল ইসলাম, তার মেয়ে ছয় মাদক মামলার আসামি নার্গিস আক্তার, একাধিক মাদক মামলার আসামি ছেলে তাজুল ইসলাম তাজু। ময়না ও তাজুল মাদকের টাকায় আত্মীয়স্বজন ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নামে গাজীপুর ও মাদারীপুরে গড়েছে বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ বিপুল সম্পদ। 

আরেক মাদকসম্রাজ্ঞী রানী বেগম ও তার ছেলে রাব্বানি ছাড়াও কারবারি রিপন মিয়া, টুক্কু, রত্না, আমির কানা ও মৃদুলসহ শতাধিক কারবারি টঙ্গীর মাদকের হাট নিয়ন্ত্রণ করছে। গাজীপুর সদর থানায় সবচেয়ে বড় মাদকের হাট ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের লক্ষ্মীপুরায়। সেখানে দেড় দশক আগে শূন্য হাতে ঢাকার ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টারসংলগ্ন চাঁনপাড়া বস্তি থেকে এসে ঘাঁটি গেড়েছিল তাহমিনা আক্তার। পরে হয়ে ওঠে মাদকসম্রাজ্ঞী। তার স্বামী মো. জুলহাস। 

তাহমিনা গাজীপুর মহানগরের বড় হেরোইন ও ইয়াবার ডিলার। তার তিন মেয়ে ও এক ছেলেও মাদক কারবারে জড়িত। মাদকের টাকায় তারা এলাকায় গড়েছে চারতলা বাড়ি। তাহমিনার বিরুদ্ধে হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা রাখার অভিযোগে সাতটি মামলা রয়েছে। তার ছেলে মো. জুয়েলের সখ্য ছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে। ওই নেতাদের প্রভাবে তাদের পুরো পরিবার কারবারে হয়ে ওঠে বেপরোয়া।

এ ছাড়া লক্ষ্মীপুরায় মাদক কারবারে কোটিপতি হয়েছে মো. হারুন ও তার স্ত্রী আশা। তাদের বিরুদ্ধে এক ডজনের বেশি মাদক মামলা রয়েছে সদর ও বাসনসহ বিভিন্ন থানায়। হারুনের ছেলে যুবলীগকর্মী মিনহাজুল আবেদীন কনক পুলিশের সোর্স। মাদকের টাকায় কনক এলাকায় গড়েছে বহুতল বাড়ি। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাবেদ আলী জবেরের ছেলে রাজনও লক্ষ্মীপুরার বড় মাদক ব্যবসায়ী ছিল। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক মামলা হয়েছে। 

জানা গেছে, ২০২২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে বাসার তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে পালানোর সময় গুরুতর জখম হয় রাজন। তার এক দিন পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।

‘নয়া ডন’ সাজাপ্রাপ্ত দাবারু : গাজীপুরের টঙ্গীর আলোচিত ভরান মাজার বস্তি মাদকহাটের একক নিয়ন্ত্রণ এখন শাহাবউদ্দিন ওরফে দাবারুর হাতে। টঙ্গীসহ বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে রয়েছে সাতটি মাদক মামলা। এর মধ্যে একটি মামলায় তিনি ৩৫ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। তার বাড়ি জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানার আইরমারী গ্রামে। দাবারু একসময় এ বস্তির শীর্ষ মাদক কারবারি বাচ্চুর ‘ডান হাত’ ছিলেন। 

২০১৮ সালের মে মাসে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বাচ্চু নিহত হলে টঙ্গী ত্যাগ করেছিল দাবারু। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বস্তিতে ফেরে সে। রবিউল ইসলাম কিং বাবু ও নূর মোহাম্মদকে সঙ্গে নিয়ে সেখানকার মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নেয় সে। স্থানীয় হোন্ডা সড়কে অফিস খুলেছে দাবারু। ক্ষমতার জোরে বস্তিতে জমি দখল করে ছোট ছোট দোকান ও ঘর উঠিয়ে ভাড়া নিচ্ছে। 

বস্তির কয়েকজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দাবারু হেরোইন, ইয়াবা, মদ, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ সব ধরনের মাদকের পাইকারি ডিলার। বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও শাহাবউদ্দিন দাবারুর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি  ইস্কান্দার হাবিবুর রহমান বলেন, টঙ্গী পশ্চিম থানা এলাকার বস্তিগুলোয় মাদকবিরোধী অভিযান চালানো হচ্ছে।

পুলিশ জানায়, গাজীপুর মহানগরের কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, বোর্ডবাজার, ভোগড়া, সালনা ও পুবাইলে রয়েছে মাদকের পাইকারি হাট। জেলার পাঁচ উপজেলার অলিগলিতেও চলছে মাদক ব্যবসা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেলায় দিনে কমপক্ষে শত কোটি টাকার মাদক কারবার হচ্ছে।

জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় ও পুলিশ সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার করা হলেও বহু কারবারি জামিনে বের হয়ে আবার এ কারবারে যুক্ত হচ্ছে। যেমন—গত ৯ মার্চ টঙ্গী পূর্ব থানা এলাকা থেকে আট হাজার পিস ইয়াবাসহ মিনারা আক্তার, রুনা আক্তারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। 

গত ১৪ এপ্রিল কালীগঞ্জ থেকে ১২ হাজার পিস ইয়াবাসহ রায়হান মিয়া ও হানিফ মিয়া এবং  ১৬ এপ্রিল তিন হাজার ৮০০ ইয়াবাসহ কালিয়াকৈর থেকে মোসলিম ভূইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। জানা গেছে, গ্রেপ্তারের ১৪ দিন পর মোসলিম ভূইয়া, ১৩ দিন পর রায়হান মিয়া, হানিফ মিয়া, মিনারা আক্তার ও ১৮ দিনের মাথায় রুনা আক্তার উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বের হয়। এভাবে গ্রেপ্তারের কিছুদিনের মধ্যে উচ্চ আদালত থেকে বহু মাদক কারবারি জামিনে মুক্ত হয়ে আবার একই ব্যবসায় জড়িয়েছে।

গাজীপুরের পুলিশ সুপার ড. চৌধুরী মো. হাসান যাবের সাদেক জানান, জেলার প্রতিটি থানায় মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চলছে। জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. এমদাদুল ইসলাম মিঠুনও জানান, মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে।

Kommentarer