আওয়ামী শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রকে জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্রে পরিণত করেছিল
‘আমরা আজ যে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী শাসনের পতন দেখেছি, সেটার নিষ্ঠুরতা আমাদের বিবেককে সামগ্রিকভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে।’
হারুন ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ : রোববার ২৭ জুলাই ২০২৫, ১৫:৪১
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জুলাই বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী’ উপলক্ষে আয়োজিত প্রথম জুলাই বিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্মেলন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জুলাই বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী’ উপলক্ষে আয়োজিত প্রথম জুলাই বিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্মেলন |নয়া দিগন্ত
শিল্প মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেছেন, ‘আমরা আজ যে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী শাসনের পতন দেখেছি, সেটার নিষ্ঠুরতা আমাদের বিবেককে সামগ্রিকভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এই শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রকে জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্রে পরিণত করেছিল।’
page-top-ad
রোববার (২৭ জুলাই) বেলা ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ‘জুলাই বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী’ উপলক্ষে আয়োজিত প্রথম জুলাই বিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (আইসিজেআর-১) প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
এর আগে, জুলাই বিপ্লবে শহীদ জাহিদুজ্জামান তানভীনের মা বিলকিস জামান ও বাবা শামসুজ্জামান বক্তব্য প্রদান করেন। এসময় তারা সকল শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে শহীদদের সনদ দাবি করেন।
সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সম্মেলনের আহ্বায়ক ড. মো: শরীফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘২০২৪-এর জুলাই বিপ্লব কেবল একটি প্রতিবাদ নয়, এটি ছিল বাংলাদেশের যুবসমাজের একত্রিত হওয়ার একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান, আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক জন এফ. ডেনিলোইজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ।
আওয়ামী শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রকে জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্রে পরিণত করেছিল উল্লেখ করে আদিলুর রহমান, ‘শুধু তাই নয়, র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সন্ত্রাসের হাতিয়ার বানানো হয়েছিল। গুম-খুন হয়ে উঠেছিল নিত্যদিনের ঘটনা। কবি, শিক্ষক, সাংবাদিক ও ছাত্রনেতাদের অপরাধী হিসেবে জেলে ভরা হয়েছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মুক্ত চিন্তায় বাধা দেয়া হতো।’
জুলাই বিপ্লবের প্রথম আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনকে তিনি শুধুমাত্র আলোচনা নয়, বরং একটি ‘সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রক্রিয়া’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা বিকৃত ইতিহাস থেকে সত্যকে উদ্ধার করতে চাই। যারা নিখোঁজ হয়েছেন, তাদের পরিবারের কান্না, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে গেঁথে থাকা গুলির চিহ্ন- এসবই একদিন ন্যায়বিচারের নির্মাণকাজে প্রমাণ হয়ে উঠবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমান বাংলাদেশ সঙ্কট উত্তরণের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার পতনই ন্যায়বিচারের গ্যারান্টি নয়। এক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের বিচারব্যবস্থাকে ভয়মুক্ত করতে হবে, নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কারসহ ছাত্র আন্দোলনকে যেকোনো দখলদারিত্ব থেকে রক্ষা করতে হবে।’
জুলাই বিপ্লবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদানের কথা স্মরণ করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবারো সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে। এর শ্রেণিকক্ষগুলো হয়ে উঠেছিল রণকৌশলের কেন্দ্র, ছাত্ররা হয়ে উঠেছিল বিবেকের যোদ্ধা। আমরা বিদেশী গবেষক, অধ্যাপক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে কৃতজ্ঞ, যারা বিপদজনক সময়েও বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।’
বক্তব্যের শেষে আদিলুর রহমান খান এই সম্মেলনকে একটি ‘জাতীয় অঙ্গীকারে’ পরিণত করার লক্ষে জুলাই বিপ্লবের দলিলপত্র, ভিডিও, ছবি নিয়ে একটি আর্কাইভ গড়ে তোলার এবং স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে জুলাই বিপ্লবের ইতিহাস সত্যনিষ্ঠভাবে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অংশে ‘ইন্ডিয়ান হেজিমোনি অ্যান্ড জুলাই রেভল্যুশন ২০২৪’ শিরোনামে কি-নোট বক্তব্য প্রদান করেন ড. মাহমুদুর রহমান।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কোনো দানশীলতা নয়, বরং সূক্ষ্ম একটি ভূ-রাজনৈতিক কৌশল ছিল বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভারত ভেবেছিল পাকিস্তান ভেঙে গেলে বাংলাদেশ ভারতের অনুগত হবে। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল যে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ জনগণ মুসলিম, যারা কখনোই হিন্দু-প্রধান ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই বাংলাদেশে ইসলামী পরিচয়ের পুনরুত্থান ঘটে।’
তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ভারত এই দেশে তাদের অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা, নিরাপত্তা হুমকি নিয়ন্ত্রণ, ভূ-প্রাকৃতিক সুবিধা ব্যবহার, দ্বিপক্ষীয় সমাধান এবং সুরক্ষা যন্ত্র হিসেবে কাজ করার এই পাঁচটি লক্ষ্য পূরণের সুযোগ পায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘ভারত নিজে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হয়েও বাংলাদেশে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারকে সমর্থন করে, কারণ তারা মনে করেছিল শেখ হাসিনার মাধ্যমেই তাদের লক্ষ্য পূরণ হবে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ভোটে ভারতের সমর্থনই তার প্রমাণ।’
তিনি ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবকে ধর্মনিরপেক্ষ, ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের এক অনন্য সংমিশ্রণ হিসেবে উল্লেখ করে তিন বলেন, ‘এই বিপ্লব শুধু আমাদের দেশেই নয়, বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি শিক্ষণীয় ঘটনা।’
অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন কূটনীতিক জন এফ. ডেনিলোইজ বলেন, ‘জুলাই বিপ্লব কোনো বিদেশী শক্তি বা গভীর রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রের ফল নয়। এটি সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব সংগ্রামের ফসল। ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীদের কাছে প্রমাণ দেয়া কঠিন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ এতে জড়িত ছিল না। আজ পর্যন্ত আমি এমন কোনো প্রমাণ দেখিনি। যদি কারো কাছে এমন কোনো প্রমাণ থাকে, আমি তা দেখাতে চ্যালেঞ্জ করছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘বিপ্লব সফল হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও তথ্যযুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে, যা এখনো চলমান। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।’