জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর একটা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পানিসম্পদ ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন দীর্ঘদিনের পরিবেশ আন্দোলনকর্মী ও আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। গত এক বছরে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সফলতা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
আগে পরিবেশ সংরক্ষণে সরকারের ভুল নীতি ও পদক্ষেপের সমালোচনা করতেন। এখন আপনি নিজেই সরকারের অংশ। এ দুই ভূমিকায় চ্যালেঞ্জগুলো কেমন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: কিছু কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো একই; যেমন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর যে প্রভাব, আমাদের সমাজে সেটা তো ৫ আগস্টের পরে আর রাতারাতি বদলে যায়নি। এখানে প্রভাবশালীদের যে প্রভাব এবং বিস্তার, সেটা সমাজের সব স্তরে কিন্তু রয়ে গেছে। ফলে যখন আমরা দূষণকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলি ওই প্রভাবটা মোকাবিলা আগেও করতে হয়েছে, এখনো করতে হচ্ছে।
আমি যে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে কাজ করি, সেটার অধীন ডিপার্টমেন্ট অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ফরেস্টের প্রধান বৈশিষ্ট্যটাই হচ্ছে নিয়ন্ত্রণমূলক, রেগুলেটরি কাজ করা। তো এই রেগুলেটরি বা প্রয়োগের কাজ করতে গিয়ে প্রথম চার-পাঁচ মাস দেখা গেছে যে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সহায়তা পাচ্ছিলাম না। সে সময় তো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক ছিল, এই একটা চ্যালেঞ্জ এখানে ফেস করেছি।
আরেকটা চ্যালেঞ্জ মাঝেমধ্যে ফেস করি, যে কথা আমার সহকর্মীরা আগে কখনো শোনেননি। যেমন আশুলিয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবৈধভাবে দখল করা জমি বা চট্টগ্রামের পতেঙ্গার পাশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের দখল করা জায়গা থেকে প্রভাবশালীদের উচ্ছেদ করে আমাদের জমি উদ্ধার করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার তাগিদ তাঁদের ভেতরে আগে কম ছিল। তবে এখন কয়েকটি জায়গায় সফল হওয়ায় তাঁরা বেশ উৎসাহী হয়ে উঠেছেন।
সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে বনের জায়গা বরাদ্দ নেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা গেছে বিগত সরকারের আমলে। এ রকম বেশ কিছু বরাদ্দ আপনার মন্ত্রণালয় বাতিল করেছে, যেটি প্রশংসিত হয়েছে। গত এক বছরে গাজীপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে প্রভাবশালীদের দখল থেকে বনের জায়গা মুক্ত করা গেল না কেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: আমি আপনার প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে বলি। বনের জায়গা যেটা তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পে খুবই স্বেচ্ছাচারীভাবে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো ফেরত আনতে পেরেছি—এভাবে আমি বলতে চাই না। বনের জায়গা উন্নয়ন প্রকল্পে দেওয়া উচিত ছিল না, আমার সহকর্মীরা এটা উপলব্ধি করেছেন। আমি যখন উদ্যোগ নিয়েছি তখন সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা রাজি হয়ে গেছেন। তারপরও কিন্তু পুরো প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। তিনটাতে প্রায় পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে আনতে পেরেছি।
আরেকটা জিনিস একটু বলে রাখা দরকার যে আমরা বন আইন সময়োপযোগী করার জন্য খসড়া প্রস্তুত করে ফেলেছি। হয়তো শিগগিরই সেগুলো ক্যাবিনেটে যাবে। বন বিভাগে একটা জিনিস আছে সেটা হচ্ছে প্রচুর মামলা তাদের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, গাছের চেয়ে মামলার সংখ্যা বেশি। আমি বন বিভাগকে নিরুৎসাহিত করছি মামলা করতে। আমি বলছি যে বড় বড় দখলদারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। নদীভাঙা মানুষ, বনবাসী—এদের বিরুদ্ধে মামলা করবেন না।
পরিবেশ আন্দোলনে আমার একটা দীর্ঘদিনের ইতিহাস আছে, সেহেতু সবাই পরিবেশের সব সমস্যার সঙ্গে আমাকে যুক্ত করে ফেলেন। কারণ, আগে তো আমি সব বিষয়েই কথা বলতাম। এখন কিন্তু আমার আইনগত ম্যান্ডেটটা লিমিটেড। অনেকেই ভাবেন নদী রক্ষা কমিশন আমার পানি মন্ত্রণালয়ের অধীনে। কিন্তু আসলে তা না। ওটা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু পানি আইনেও আমার কিছু কিছু কাজ করার সুযোগ আছে। পরিবেশ আইনে আমার দূষণ বন্ধ করার সুযোগ আছে।
এবার নদীর প্রসঙ্গে আসি। আপনার কাজের আপনার আন্দোলনের একটা মুখ্য জায়গা ছিল নদী রক্ষা করা, নদীর দূষণ বন্ধ করা, নদীর ওপর যে ধরনের বাস্তুতান্ত্রিক ক্ষতি করা হচ্ছে ওগুলো থেকে নদীকে রক্ষা করা। গত এক বছরে নদীর দূষণ, দখল বন্ধে আমরা কোনো দৃশ্যমান উন্নতি দেখতে পাইনি। সেটি হয়নি কেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: পরিবেশ আন্দোলনে আমার একটা দীর্ঘদিনের ইতিহাস আছে, সেহেতু সবাই পরিবেশের সব সমস্যার সঙ্গে আমাকে যুক্ত করে ফেলেন। কারণ, আগে তো আমি সব বিষয়েই কথা বলতাম। এখন কিন্তু আমার আইনগত ম্যান্ডেটটা লিমিটেড। অনেকেই ভাবেন নদী রক্ষা কমিশন আমার পানি মন্ত্রণালয়ের অধীনে। কিন্তু আসলে তা না। ওটা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু পানি আইনেও আমার কিছু কিছু কাজ করার সুযোগ আছে।
পরিবেশ আইনে আমার দূষণ বন্ধ করার সুযোগ আছে। দেশের সব নদ-নদীর তালিকা নিয়ে সব সময় বিতর্ক থাকত। এবার সব বিভাগীয় পর্যায়ে বিভাগীয় কমিশনারদের সঙ্গে একজন করে নদীকর্মী সংযুক্ত করে দিয়ে অন্যান্য সরকারি সংস্থা, যেমন নদী রক্ষা কমিশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সবাইকে সম্পৃক্ত করে দিয়ে নদীর একটা তালিকা আমরা করেছি। এ তালিকা নিয়ে খুব বেশি সমালোচনা হয়নি।
আমাদের নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের লোকবল ১৫০-এর মতো। তাদের গবেষণার বাজেট ছিল ৪৩ লাখ টাকা। ৪৩ লাখ টাকা দিয়ে একটা প্রতিষ্ঠান কী গবেষণা করবে? এবার তাদের আমরা চার কোটি টাকার মতো দিতে পেরেছি। তারা বাংলাদেশের সংকটাপন্ন নদীগুলোর তালিকা করবে। নদীগুলো কেন সংকটাপন্ন এবং সংকট উত্তরণে কী করণীয়, সেটা খুঁজে বের করবে। আরেকটা তারা করবে সেটা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সুন্দরবনের নদীগুলোর সার্ভে করবে। এ ছাড়া পাথর ও বালু উত্তোলনের ফলে নদীগুলোর যে ক্ষতিটা হচ্ছে, সেটা নিয়েও কাজ করবে।
শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা ও বালু—ঢাকার এ চারটা নদ–নদীর দখল–দূষণের ক্ষেত্রে কী করণীয়, সেটার কর্মপরিকল্পনা হয়ে গেছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন বিভাগ থেকে মোট ১৬টি নদীকে আমরা বেছে নিয়েছি। ১৬টি নদীরই কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে।
দুটো ভালো খবর দিয়ে দিই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটা স্লুইসগেটের কারণে নেত্রকোনায় মগড়া নদী তার সংযোগস্থল থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। আমরা সেই রেগুলেটরটা সরিয়ে দিয়েছি এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় আমরা সেটার ওপরে একটা বেইলি ব্রিজের কাজ শুরু করে দিয়েছি। এখন মগড়া নদীটা তার উৎসের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গেছে।
দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, বড়াল নদের ওপর নির্মিত দুটি স্লুইসগেট অপসারণ। আমরা সেটা করেছি। টিএমএসএস নামে একটি সংস্থা করতোয়া নদীর কিছু অংশ দখল করে রেখেছিল। সেই দখলটা আমরা উচ্ছেদ করে দিতে সক্ষম হয়েছি।

শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দূষণও বন্ধ করা যায়নি। দূষণ বন্ধে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: দূষণের ক্ষেত্রে আমরা এ পর্যন্ত একটি সিসা কারখানাকে বন্ধ করতে পেরেছি। দূষণের ব্যাপারে আমার অবশ্যই ব্যাখ্যা দেওয়ার আছে। আমার ডিপার্টমেন্টে ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছেন ছয়জন। এই ছয়জন ম্যাজিস্ট্রেট শীতকালে ব্যস্ত থাকেন ইটভাটা ভাঙতে। আর গ্রীষ্মকালে ব্যস্ত থাকেন পলিথিনসংক্রান্ত এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে অন্য যে অভিযোগগুলো আসে, সেগুলো দেখতে।
শিল্পদূষণ বহু বছর ধরে আমাদের একটা বাস্তবতা ছিল। এটার ব্যাপারে যদি কঠোর হতে চাই, তাহলে কর্মসংস্থানের বিষয়টা চলে আসবে। কিন্তু যে হ্যাবিচুয়াল পলিউটার (অভ্যাসগত দূষণকারী) তাকে তো ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এক-দেড় বছরে আমরা সব করে যেতে পারব না। কিন্তু দু–একটা ক্ষেত্রে আমরা দেখিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব যে অন্তত দুই-তিনটা নদীর সব দখলদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
অনেক কাজ আমাদের পরিবেশকর্মীদের দিয়ে করিয়ে নেওয়া যায়, সাংবাদিক ভাই-বোনদের নিয়ে করিয়ে নেওয়া যায়; কিন্তু আইনের
প্রয়োগ করতে তো আমার ডিপার্টমেন্টের লোকই লাগবে, সেখানে আমার একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সেখানে আমাকে একটু চিন্তা করে কাজ করতে হচ্ছে।
একটা ভঙ্গুর সময়ে আপনারা দায়িত্ব নিয়েছেন এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকরী হতে হতে অনেকটা সময় লেগে গেছে। সিলেটে পাথর কোয়ারি দেখতে গিয়ে আপনার গাড়িবহরও একটি দলের কর্মীদের বাধার মুখে পড়েছে। আমাদের এই রাজনৈতিক বাস্তবতাটা পরিবেশ সংরক্ষণের কতটা অনুকূল বলে আপনি মনে করেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: এই বাস্তবতা অনুকূলে নয়, কিন্তু এই বাস্তবতাটাকে যদি একবার ওভারকাম করা যায়, তাহলে কিন্তু অন্যরা সতর্ক হবে। সিলেটে আমি এবং ফাওজুল কবির ভাই আক্রান্ত হয়েছিলাম। আমার গাড়ি তো ৭ থেকে ১০ মিনিট আটকে রেখে যত রকমের স্লোগান দেওয়া যায়, তারা দিল। কিন্তু আমরা ওখান থেকে চলে আসার পর ব্যাপক অভিযান শুরু করা হয়।
পত্রিকা আর টিভিতে পাথর উত্তোলনের বিষয়টি যেভাবে এখন আসছে, আগে কিন্তু সেভাবে আসেনি। ফলে একটা জনসমর্থন তৈরি হয়েছে। এ রকম জনসমর্থন যদি পাওয়া যায়, তাহলে কিন্তু পরিস্থিতি ওভারকাম করতে অনেক সহজ হয়। যেমন ধরেন ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের কথা বলবেন, পুরোনো বাস তুলতে গেলে কেউ কেউ ধর্মঘটের ডাক দেবে। এতটা বছর ধরে আমরা এই পুরোনো বাসগুলোকে চলতে দিয়েছি। আমরা কি এক বছরে এই পুরোনো বাসগুলোকে রাস্তা থেকে তুলে নতুন বাস দিতে পারব? সেটা তো সম্ভব নয়।
শব্দদূষণ বন্ধে নীরব এলাকা ঘোষণা করেছেন। বাস্তবে কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করেন কি?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: শব্দদূষণ নিয়ে বিগত সরকারের একটা প্রকল্প ছিল। আমি যখন এসে দেখলাম ওই প্রকল্পের অর্ধেক টাকাই খরচ হয়ে গেছে, তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম এ প্রকল্পের প্রভাব কী পড়েছে? আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে কোনো প্রভাব ফিল করি না। তখন আমি বললাম যে এই প্রকল্প যেভাবে আছে আমি সেভাবে আর বাস্তবায়ন করব না। তখন প্রকল্পটা আমরা রিভাইজড ফর্মে দিলাম।
রিভাইজড ফর্মে কী কী থাকবে? এক হচ্ছে, যানবাহন চালকের ট্রেনিং থাকবে। দুই হচ্ছে, ক্যাম্পেইন থাকবে। আপনারা হয়তো এবার দেখেছেন যে এয়ারপোর্টে আমরা একটা ক্যাম্পেইন করেছি, সচিবালয় একটা ক্যাম্পেইন করেছি। সেখানে স্কুল–কলেজের বাচ্চারা নানাভাবে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। তৃতীয়ত হচ্ছে, আইন প্রয়োগের ওপর জোর দেব। পুরো ঢাকা শহরে হয়তো পারব না, কিন্তু কয়েকটা এলাকা দিয়ে শুরু করব।
এটা করতে হলে ট্রাফিক সার্জেন্টকে আমাদের ক্ষমতা দিতে হবে। আমরা নতুন যে দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা করেছি সেখানে, আমরা ট্রাফিক সার্জেন্টকে ক্ষমতা দিচ্ছি। যে গাড়ি হর্ন বাজাবে, তিনি সেই গাড়িকে সে ফাইন করতে পারবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।
(সাক্ষাৎকারটি ২৮ আগস্ট ২০২৫ প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকায় ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হচ্ছে’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।)