এই শরতে শাপলার বিল দেখতে কোথায় ও কীভাবে যাবেন, খরচ কত পড়বে

Comments · 25 Views

ডিবির হাওরে পৌঁছেই বুঝতে পারি মস্ত বোকামি হয়ে গেছে। শেষ বিকেলে হাওরজুড়ে কিছু লাল শাপলা ফুটে আছে বটে, তবে তাদের

সিলেটের জৈন্তাপুরে ভারত সীমান্তবর্তী চারটি বিল একসঙ্গে ডিবির হাওর নামে পরিচিত, এখন অবশ্য অনেকে চেনে ‘লাল শাপলার বিল’ নামে। অজস্র শাপলা ফুটে থাকে এই বিলে। সেই ছবি নেট–দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে একে আলাদা খ্যাতি এনে দিয়েছে, সেই খ্যাতির মোহে একজনের জোরাজুরিতে আমারও যাওয়া।

আমাদের মতো ভুল সময়ে আরও কিছু মানুষও সেদিন এসেছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ নিরুপায় বসে না থেকে ডিঙি ভাড়া করে বিলের গভীরে যান। ডাঁটাসহ শাপলা ফুল হাতে নিয়ে ছবিও তুলতে থাকেন। হাসিমুখে ছবি তুললেও বুঝতে কষ্ট হয় না তাঁদের মনও মিইয়ে পড়া শাপলার মতোই।

তখনই একজনের মুখে প্রশ্নটার উদয়, তাহলে ছবি তোলার জন্য দিনের কোন সময় শাপলাবিলে আসা উচিত?

বললাম, উত্তর জানতে হাজার বছর ধরে উপন্যাসে ফিরে যেতে হবে। মন্তু আর টুনির শাপলা তোলার সেই বর্ণনা মনে আছে? আরেকবার মনে করিয়ে দিই, ‘ওরা আসে ধল-পহরের আগে, যখন পুব আকাশে শুকতারা ওঠে। তার ঈষৎ আলোয় পথ চিনে নিয়ে চুপিচুপি আসে ওরা। রাতের শিশিরে ভেজা ঘাসের বিছানা মাড়িয়ে ওরা আসে ধীরে ধীরে। টুনি ডাঙায় দাঁড়িয়ে থাকে।

মন্তু নেমে যায় পানিতে।

তারপর, অনেকগুলো শাপলা তুলে নিয়ে, অন্য সবাই এসে পড়ার অনেক আগে সেখান থেকে সরে পড়ে ওরা।’

সত্যিই তা–ই, ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই যে জেগে ওঠে হাওর-বিল। জলের বুকে ভেসে থাকে সবুজ পাতার মেলা, আর তার মধ্যেই যেন নেচে ওঠে অনাদরে বেড়ে ওঠা লাল-সাদা শাপলা।

ভোরের আলোয় দেখা যায়, শাপলা ফুলের ফাঁকে হালকা কুয়াশার ভেসে বেড়ানো। শিশিরভেজা শাপলার দঙ্গল সরিয়ে বইঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে নৌকা নিয়ে এগিয়ে যান জেলেরা। কেউ মাছ ধরেন, কেউ তোলেন শাপলা লতা।

এভাবেই শুরু হয় বিলপারের মানুষের জীবন। প্রকৃতির এই অনিন্দ্যসুন্দর ফুল গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে মিশে আছে শত শত বছর। তাই তো বাংলাদেশের জাতীয় ফুলের মর্যাদা পেয়েছে সাদা শাপলা।

শাপলার স্নিগ্ধতায় যুগে যুগে মোহিত হয়েছেন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষেরা। কবিতা, গল্প, উপন্যাসে আছে যার প্রকাশ। আর এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তার প্রকাশ দেখা যায়।

ইদানীং বিলপারের মানুষের সঙ্গে আরও একদলকে শাপলাবিলে দেখা যায়, জীবিকার টানে নয়, রঙিন শাপলার অতিথি হতে যান তাঁরা। মুঠোফোন ছাড়াও জম্পেশ আয়োজনে পেশাদার আলোকচিত্রীসহ ছবি তোলেন।

বেড়ানোর ছুতায় কিংবা বিয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে ছুটে যান তাঁরা। তাই শরৎ এলেই ফেসবুকে শাপলাবিল হয়ে যায় ট্রেন্ডি।

বর্ষার শেষ ভাগ থেকে শরতের শুরুতেই দেশের বিভিন্ন হাওর-বিলে শাপলা ফুটতে শুরু করে। সিলেট থেকে বরিশাল, ময়মনসিংহ থেকে পঞ্চগড়—দেশের সর্বত্রই এ সময় মেলে রঙিন শাপলার অপূর্ব সমাহার।

মন্তু আর টুনি চুপিসারে বিলে গেলেও হালের তরুণেরা এ সময় হাজির হন আয়োজন করে। ছবি তোলার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে পোশাকও বেছে নেন। নানা রঙের পোশাকের চল দেখা যায়।

মেয়েরা পরেন সাদা, লাল, ম্যাজেন্টা, হলুদ ইত্যাদি রঙের শাড়ি। অনেকে স্কার্টও পরেন। খোলা চুলে নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে ছবি তোলেন। সঙ্গী পুরুষ থাকলে তাঁর জন্য নেওয়া হয় পাঞ্জাবি।

তরুণদের হাত ধরেই দেশে কয়েক বছর ধরে ‘শাপলা ট্যুরিজম’ প্রসার লাভ করেছে। ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন ভ্রমণ গ্রুপ দেশের নানা প্রান্তে শাপলাবিল ঘুরে দেখানোর আয়োজন করছে।

তাদের সঙ্গে দল বেঁধে তরুণেরাও ছুটে যাচ্ছেন। এই উপলক্ষে বিলপারে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী দোকান, পর্যটকদের বিল ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য বসে থাকেন স্থানীয় লোকজন। একসময় যাঁরা শাপলা তুলে বাজারে বিক্রি করতেন, তাঁদের অনেকেই হয়ে উঠেছেন ট্যুরিস্ট গাইড।

‘ঘুরান্তিস’ তরুণ আর শখের আলোকচিত্রীদের হাত ধরে ডিবির হাওরের মতো শাপলা ফুলের জন্যই বিখ্যাত হয়েছে বরিশালের উজিরপুরের সাতলার বিল, ময়মনসিংহের গৌরীপুরের সিধলং বিল, মুন্সিগঞ্জের আড়িয়ল বিল, নওগাঁর চন্দ্রদিঘিসহ আরও ছোট-বড় বিল। কোথাও কোথাও বাণিজ্যিকভাবেও বিল ঘুরিয়ে দেখানোর আয়োজন করা হয়েছে।

এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ‘পদ্ম-শাপলা রিসোর্ট’ ঢাকাবাসীর সবচেয়ে কাছাকাছি। বিলজুড়ে পদ্ম ও শাপলা ফুল যেন হাত ধরাধরি করে নাচছে।

নকশার এই বিশেষ আয়োজনের ফটোশুটও হয়েছে সেখানেই। শাপলা নিয়ে আয়োজন হলেও অভিনেত্রী সুনেরাহ বিনতে কামাল হাতে তুলে নিলেন পদ্মও।

ঢাকার অদূরের এই বিলকেন্দ্রিক রিসোর্টে প্রবেশমূল্য ৫০ টাকা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের ২০টি নৌকায় দর্শনার্থীরা ঘুরতে পারেন। এক নৌকায় সর্বোচ্চ তিনজন উঠতে পারেন। শুক্র ও শনিবার ৩০০ টাকার বিনিময়ে ৪০ মিনিট, অন্যান্য দিন এক ঘণ্টা ঘুরতে পারেন।

নগরবাসীর কাছে এত দিন শরতের রং ছিল আকাশের সাদা-নীল, কাশফুলের ধবধবে সাদা আর শিউলি ফুলের সাদা, কমলা। এখন যেন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে শাপলা ফুলের লাল আর সাদা।

 
Comments