অভূতপূর্ব ঘটনা: তিনজনের ডিএনএ থেকে বংশগত রোগমুক্ত শিশুর জন্ম!

Kommentarer · 51 Visninger

যুক্তরাজ্যে এখন পর্যন্ত আটটি শিশু জন্ম নিয়েছে, যাদের জেনেটিক উপাদান তিনজন মানুষের ডিএনএ থেকে তৈরি। চিকিৎসকর?

যুক্তরাজ্যে এখন পর্যন্ত আটটি শিশু জন্ম নিয়েছে, যাদের জেনেটিক উপাদান তিনজন মানুষের ডিএনএ থেকে তৈরি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে ভয়াবহ ও প্রায়ই প্রাণঘাতী বংশগত রোগ প্রতিরোধের জন্য। 

যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতির পথিকৃৎ। এতে একটি মা ও বাবার ডিম্বানু ও শুক্রানুর সঙ্গে আরেকজন নারীর দানকৃত দ্বিতীয় একটি ডিম্বানু মিলিয়ে ব্যবহার করা হয়।

এই প্রযুক্তিটি যুক্তরাজ্যে এক দশক ধরে বৈধ হলেও, এখনই প্রথমবার প্রমাণ মিলেছে যে এটি সত্যিই এমন শিশুদের জন্ম দিচ্ছে, যারা দুরারোগ্য মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ থেকে মুক্ত।

এই রোগগুলো সাধারণত মায়ের মাধ্যমে সন্তানের শরীরে পৌঁছে এবং শরীরকে প্রয়োজনীয় শক্তি থেকে বঞ্চিত করে।

ফলে মারাত্মক প্রতিবন্ধিতা হতে পারে এবং কিছু শিশু জন্মের কয়েক দিনের মধ্যেই মারা যায়। যদি আগের কোনো সন্তান, পরিবারের সদস্য অথবা মা এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে ঝুঁকির বিষয়টি আগে থেকেই জানা যায়।

তিনজন মানুষের ডিএনএ ব্যবহার করে জন্মানো শিশুরা তাদের বেশিরভাগ জেনেটিক উপাদান—অর্থাৎ বংশগত নকশা—পায় তাদের মা-বাবার কাছ থেকে, তবে একেবারে অল্প পরিমাণ, আনুমানিক ০.১ শতাংশ, পায় দ্বিতীয় নারীর কাছ থেকে। এই পরিবর্তন ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও চলতে থাকে।

যেসব পরিবার এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছেন, তারা গোপনীয়তা রক্ষার জন্য প্রকাশ্যে কিছু বলেননি, তবে নিউক্যাসল ফার্টিলিটি সেন্টারের মাধ্যমে তারা বেনামে বিবৃতি দিয়েছেন, যেখানে এই প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন হয়েছে।

কীভাবে কাজ করে এই তিন-ডিএনএ প্রযুক্তি?

মানুষের শরীরে প্রায় প্রতিটি কোষে থাকে মাইটোকন্ড্রিয়া—ক্ষুদ্র একক যা অক্সিজেন ব্যবহার করে খাবারকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে। এই শক্তিই শরীরের সমস্ত কার্যাবলী চালিয়ে যায়। কিন্তু যদি মায়ের মাইটোকন্ড্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে তা সন্তানের দেহে গিয়ে মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ সৃষ্টি করে। এতে শিশুর হৃদস্পন্দন থেমে যেতে পারে, হতে পারে স্নায়বিক জটিলতা, অন্ধত্ব, পেশিশক্তি হ্রাস এবং অঙ্গ বিকল হওয়ার মতো মারাত্মক সমস্যা।

প্রতি ৫,০০০ শিশুর মধ্যে একজন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে জন্মায়। অনেক পরিবার এর ফলে একাধিক সন্তান হারিয়েছে। নতুন এই প্রযুক্তিতে মায়ের ও ডোনার নারীর ডিম্বাণু এবং বাবার শুক্রাণু একত্রে ব্যবহার করা হয়। উভয় ডিম্বাণুই বাবার শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত করা হয়। এরপর গঠিত প্রো-নিউক্লিয়াস—অর্থাৎ মায়ের ও বাবার প্রধান ডিএনএ; দুই নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে বের করে নেওয়া হয়। পরে মা-বাবার ডিএনএ স্থাপন করা হয় সেই ডোনার নারীর সুস্থ মাইটোকন্ড্রিয়াযুক্ত নিষিক্ত ডিম্বাণুতে।

ফলে শিশুটি তার অধিকাংশ জেনেটিক বৈশিষ্ট্য—যেমন চোখের রঙ, উচ্চতা, আচরণ—পায় মা-বাবা থেকে, কিন্তু প্রায় ০.১% জেনেটিক উপাদান আসে ডোনার নারীর মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে। এই পরিবর্তন ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও বহনযোগ্য।

‘শিশুদের শরীরে মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ নেই’

নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত দুটি গবেষণায় বলা হয়, এ পর্যন্ত ২২টি পরিবার এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এতে জন্ম নিয়েছে চারটি ছেলে ও চারটি মেয়ে, যার মধ্যে একটি যমজ জুটি রয়েছে এবং একটি গর্ভধারণ এখনো চলছে।

অংশ নেওয়া সকল শিশুই মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগমুক্ত এবং প্রত্যাশিত শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ধাপ অতিক্রম করেছে। একটি শিশুর হালকা এপিলেপ্সি ধরা পড়লেও তা নিজে থেকেই সেরে যায় এবং একটি শিশুর হৃৎস্পন্দনে সামান্য সমস্যা রয়েছে, যা চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এগুলোর সঙ্গে মাইটোকন্ড্রিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।

ভবিষ্যতের আশা

গবেষণায় দেখা গেছে, পাঁচটি শিশুর ক্ষেত্রে মায়ের ত্রুটিপূর্ণ মাইটোকন্ড্রিয়া একেবারেই সনাক্ত করা যায়নি। বাকি তিনটির ক্ষেত্রে ৫ থেকে ২০ শতাংশ মাইটোকন্ড্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ পাওয়া গেছে—যা ৮০% এর নিচে থাকলে সাধারণত রোগ সৃষ্টি করে না। এটি নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেরি হারবার্ট বলেন, “এই ফলাফল আমাদের আশাবাদী করে তুলছে। তবে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা বুঝতে আরও গবেষণা আবশ্যক, যাতে ভবিষ্যতে আরও ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।”

নৈতিক বিতর্ক ও সম্ভাবনা

তবে প্রযুক্তিটি নিয়ে বিতর্ক একেবারে থেমে নেই। কারণ মাইটোকন্ড্রিয়া নিজেই একটি ক্ষুদ্রতর ডিএনএ বহন করে এবং এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও বহনযোগ্য। মেয়ে শিশুরা এটি ভবিষ্যতের সন্তানদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে। ফলে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, এটি জেনেটিক মডিফিকেশন বা ‘ডিজাইনার বেবি’-র দিকে একধরনের পদক্ষেপ হতে পারে।

কিন্তু এ সমস্ত বিতর্কের মাঝেও যুক্তরাজ্য এই প্রযুক্তির পথিকৃত হিসেবে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। অধ্যাপক স্যার ডগ টার্নবুল বলেন, “এই সাফল্য কেবল যুক্তরাজ্যেই সম্ভব হয়েছে; বিশ্বমানের বিজ্ঞান, সংসদীয় আইন, এনএইচএস’র সহায়তা এবং এর ফলাফল—আটটি সুস্থ শিশু। এর চেয়ে আনন্দজনক কিছু হতে পারে না।”

লিলি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা লিজ কার্টিস বলেন, “বছরের পর বছর অপেক্ষার পর এখন নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এই পদ্ধতিতে জন্ম নেওয়া আটটি শিশুর কেউই মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগে আক্রান্ত নয়। অনেক পরিবারের জন্য এটি এই রোগের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলার প্রথম বাস্তব আশার প্রদীপ।”

Kommentarer